| দুপুর ১২:২৬ - বৃহস্পতিবার - ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

হজে শয়তানকে পাথর মারার স্তম্ভের নকশাকার বাংলাদেশের ইব্রাহীম

লোক লোকান্তরঃ  পবিত্র হজ পালন করতে গেলে জামরাতে শয়তানকে পাথর মারার জন্য হাজিদের সৌদি আরবের মিনায় অবস্থান করতে হয়। যে তিনটি স্তম্ভে পাথর মারতে হয়, তাকে বলা হয় জামরা বা পাথরের স্তূপ। এটা শয়তানের প্রতীকী স্তম্ভ।

 

পাথর মারার ক্ষেত্রে আগে কোনো নিয়ম ছিল না। যে যেদিক থেকে যেভাবে পারতেন পাথর মারা শুরু করতেন। এতে বিশৃঙ্খলায় পদদলিত হয়ে প্রাণ হারাতেন হাজিরা। প্রথম জামরার নাম জামরাতুল আকাবা, মধ্যেরটি উস্তা ও শেষেরটি উলা। একটি থেকে অন্যটির দূরত্ব প্রায় ৩৩০ মিটার।

 

বাংলাদেশের প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীম এবং তার স্ত্রী হজে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে মর্মাহত হন এবং এ সমস্যা কিভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করেন। দেশে ফিরে তিনি শয়তানকে পাথর মারার একমুখি বিজ্ঞানসম্মত চারটি ধাপ সম্পন্ন প্রকল্প প্রণয়ন করেন।

 

এগুলো হচ্ছে, প্রতিটি জামরাকে বেড়া দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত করতে হবে, যাতে উভয়দিকে দু’টি রাস্তার সৃষ্টি হয়। জামরার দেয়াল ছিল মাত্র ছয় ফুট বাই ছয় ফুট, তা উভয়দিকে অন্তত ৩০ ফুট করে বাড়িয়ে নেয়া হয়। একমুখী ট্রাফিক সিগনালের ব্যবস্থা করা ও মিনার দিকে ‘ইন’ ও অপর প্রান্তে ‘আউট’ বসিয়ে হাজিদের চলাচল একমুখি করা।

 

একদিক দিয়ে ঢুকে পাথর মেরে অপরদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবেন হাজিরা কিন্তু কেউ পেছনে ফিরবেন না। এই হলো প্রস্তাবিত প্রকল্পের সংক্ষিপ্তসার।

 

একটি সুবিস্তারিত প্রকল্প প্রণয়ন করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ে জমা দেন প্রকৌশলী ইব্রাহীম। সেখান থেকে ঢাকার সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে সৌদি সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

 

এ পরিকল্পনা এতটাই নিখুঁত ছিল যে, সৌদি বাদশা ফাহাদ প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীমকে ‘মুহিব্বুল খায়ের’ বা কল্যাণকামী হিসেবে উপাধিতে দেন। তার জন্য উপহারসামগ্রীও পাঠান।

 

শুধু তাই নয়, পরে তাকে পবিত্র মক্কায় প্রকল্প-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

 

কাবা শরীফের তৎকালীন প্রধান ঈমাম শায়খ আবদুস সুবাইল বলেছিলেন, পৃথিবীর ১০ জন সেরা প্রকৌশলীদের মধ্যে ইব্রাহীম অন্যতম। কেননা এর আগে হাজারো প্রকৌশলী হজ্ব করে গেলেও কেউ কখনো এ বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি বা সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ নেননি। তার নাম এখনও জামারাতে লেখা আছে।

 

মিনায় বর্ধিত প্রকল্পের পাশে রাস্তার ধারে ‘মোহান্দেস ইব্রাহিম মিনাল বাংলাদেশ’ ও ‘Engineer Ibrahim from Bangladesh’ সবুজ গালিচায় সাদা অক্ষরে লিখে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল। মুসলিম বিশ্বে তিনি ‘আর্কিটেক্ট অব মোডিফিকেশন প্লান অব জামরা’ নামে খ্যাত।

 

প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইব্রাহীম ১৯৪১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বাবুপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলহাজ মো. ইদ্রিস চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষ্ণগোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

 

মেধাবী ছাত্র মোহাম্মদ ইব্রাহীম ১৯৬২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে উঠে স্বাস্থ্যগত কারণে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইগ্রেশন নিয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর জাপানে উচ্চতর ডিগ্রী গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে শিক্ষা বিভাগ, বিআরটিসি, ওয়াপদা এবং সর্বশেষ বিসিআইসিতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

 

বিসিআইসির প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসর গ্রহণকারী মোহাম্মদ ইব্রাহীমের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে How to build a nice home বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।

 

তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রাহে মক্কা রাহে, মদিনা ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং, কোরানিক গাইড, হজ্ব পরিক্রমা, স্বল্পমূল্যে গ্রহনির্মাণ, আল কুরআনে আধুনিক বিজ্ঞান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

 

তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাবুপুর গ্রামে ইসলামিয়া ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। তার অনুদানে কয়েকটি মাদরাসা ও মসজিদ পরিচালিত হয়।

 

মুসলিম বিশ্বে ‘আর্কিটেক্ট অব মডিফিকেশন প্লান অব জামরা’ নামে খ্যাতিমান এই মহান প্রকৌশলী ২০১৭ সালের ৮ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

সর্বশেষ আপডেটঃ ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ২৫, ২০২০