জাফর ইকবাল স্যারের কাছে খোলা চিঠি
অনুপম মাহমুদঃ স্যার, একসময় কোথাও ঘুরতে গেলে একটা লাল ছোট ব্যাগ আপনার সাথে সবসময় থাকত বলে শুনেছি। দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা চিঠি থাকত সেই ব্যাগে। আমি এটাও শুনেছি আপনি সব চিঠিই পড়তেন এবং যথাসম্ভব তাদের উত্তর লিখে পাঠাতেন।
এই শতাব্দীর শুরুর দিকে বন্যা হয়েছিলো খুব, আমি তখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আপনি একটা উদ্যোগ নিলেন, সিলেট বিভাগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের পাশে দাঁড়াবেন। আমরা তখন দল বেঁধে স্যালাইন বানিয়েছি ক্লাসরুমে। যেসব স্কুলে পানি উঠেছে, সেইসব স্কুলে গিয়েছি আমরা সদলবলে। তাদের জন্য উপহার হিসেবে ছিল একটা করে স্কুল ব্যাগ।
সেই ব্যাগে ছিল কিছু শিক্ষা উপকরণ। এই ব্যাগে আপনি কিছু শাক সবজি ও ফলের বীজ দিয়ে দিতে বলেছিলেন, আমরা সেটাও দিয়েছিলাম।
ব্যাগে আরও একটি চমক ছিলো, আর সেটা হলো একটা করে পোস্টকার্ড। বাচ্চাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ার খুব সুন্দর একটা মাধ্যম ছিল সেদিন, চিঠি। স্যার, এখন পোস্ট অফিসে কেউ চিঠি নিয়ে যায় কি না জানি না, আমি নিজেও যাই না। তাই এই খোলা চিঠি…
স্যার, এই দেশে পিতা মাতাকে ভরণপোষণ দিতে সন্তানকে বাধ্য করার জন্য আইন করা হয়েছে ২০১৩ সালে। আবার এই দেশেই একদল অভিভাবক নিজেরা চাঁদা তুলে একটি তহবিল গঠন করেছেন। দুইজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের লক্ষ্য, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগাড় করে তার সমাধান দ্রুত সন্তানদের কাছে পৌঁছে দিয়ে ভালো ফলাফল নিশ্চিত করা। সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের এমন ভালোবাসা আপনি আমি কেউ দেখতে চাই বা না চাই, এটা নিশ্চিত। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় সবকটি প্রশ্নই ফাঁস হয়েছে।
বৃষ্টি হয়ে কান্না ঝড়ুক আজ
স্যার, এই খোলা চিঠি আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে লিখছিলাম আপনার সাম্প্রতিক একটি কলাম পড়ে ‘বাজিয়ে যাই ভাঙা রেকর্ড’। অনুরোধ জানাতে চেয়েছিলাম সেই রেকর্ড যেন না থামে। কেউ তো একজন আছেন, যিনি আমাদের হয়ে কথা বলেন। এই প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার আকুতি জানাতে চেয়েছিলাম। আপনি এর আগে বৃষ্টি উপেক্ষা করেও শহীদ মিনারে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অযাচিত কথার বানে বিদ্ধ করা হয়েছে আপনাকে বারবার, আপনি থেমে থাকেননি।
স্যারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনী কার নিরাপত্তা দিয়েছে? এই ছবিটাই কি যথেষ্ট নয়?
আপনার উপর আঘাত আসতে পারে আশঙ্কা ছিল। আঘাত এসেছে অনেকবার, কিন্তু আপনাকে স্পর্শ করনি। কয়েক বছর ধরে আপনার নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিয়োজিত। রাষ্ট্রীয় মানব সম্পদের অপচয় আর আমাদের কষ্টের করের পয়সায় শ্রাদ্ধ দেখলাম স্যার গতকাল।
খুনি আপনার কাছ থেকে এক নিঃশ্বাসের দূরত্বে আর তাদের দুই জন (পাশাপাশি তিন জন ছিলেন তারা) মোবাইলে ফোরজি উপভোগ করছিলেন হয়ত। এভাবেই একটি কলঙ্কে যুক্ত হলো শাবিপ্রবি। টিভি ক্রলে ব্রেকিং নিউজ দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। ভুল দেখছিলাম কি…
১৯৯৭ সালে এইসএসসি পাস করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব বলে আর কোথাও পরীক্ষা দেইনি। সেখানে যে বিষয় পেয়েছিলাম, তা মন মতো হয়নি, আব্বার মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল করলে পাওয়া যেত একটা ভালো বিষয়। আব্বা সেদিন বলে দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো সাবজেক্টে ভর্তি হতে পারবে তুমি, এই কারণে সেদিন যুদ্ধ করিনি। মুক্তিযোদ্ধা বাবার সনদ এই জীবনে কোথাও কাজে লাগাইনি। চাইনি কোন বাড়তি সুযোগ। সেসময় পত্রিকায় একটা কলামে পড়লাম অভ্যন্তরীণ কারণে একদিনের জন্যও বন্ধ থাকেনি শাবিপ্রবি। লিখেছিলেন স্যার আপনিই।
এভাবে আপনাকে দেখতে চাইনি স্যার…
দিপু নাম্বার টু দিয়ে প্রথম আপনার সাথে পরিচয়। তখন স্কুলে পড়ি। তার পর সায়েন্স ফিকশন থেকে শুরু করে কলাম সবই আমার ভীষণ প্রিয়। শাবিপ্রবিতে যে আর্টস এর সাবজেক্ট আছে, সেটা আমার জানাই ছিল না। স্যারের সেই কলামে উদ্বুদ্ধ হয়ে পা বাড়িয়েছিলাম সিলেটে।
তখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিলে প্রতি ১০০ নাম্বারে ১ এর বিপরীতে .৮ কাউন্ট করা হত। স্রোতের উল্টো সাঁতার কেটে সুযোগ পেয়েছিলাম। এই ক্যাম্পাস আমাকে পরিপূর্ণ মানুষ করেছে। জীবন বোধ শিখিয়েছে, বাস্তবতা ও কল্পনার তফাৎ শিখেছি এখানে হাতে কলমে।
ক্যাম্পাসে কথনো হাঁটতেন না আপনি, বলা ভালো দৌঁড়াতেন। রোদ বৃষ্টি কিংবা ঝড়ে কোনদিন রিকশায় অথবা গাড়িতে আপনাকে দেখার সুযোগ হয়নি। খুব হাঁটতেন, আর আপনার সাথে একটু দেখা হবে এই লোভে বার বার সামনে পড়ে গিয়ে সালাম দিতাম।
কাঁচাপাকা চুল আর চশমার আড়ালে আপনার সেই চোখ ছিল ভীষণ প্রত্যয়ী আর লড়াকু। আম্মা আর ছোটবোন যেদিন ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন, আপনার সাথে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আম্মা এখনো বলে আপনার কথা।
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন ‘Youth Forum for Democracy’, সহযোগিতায় ব্রিটিশ কাউন্সিল। উদ্দেশ্য বিতর্কের মাধ্যমে গণতন্ত্র চর্চাকে উৎসাহিত করা। আপনাকে শাবিপ্রবির উপদেষ্টা হতে আহ্বান জানালে সিএসই বিভাগের ফাইনাল সেমিস্টারের ছাত্র হাবিব ভাইকে দায়িত্ব দিলেন।
২০০১ সালের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিল। আপনি তখন নিষিদ্ধ এক প্রকার। হাবিব ভাই স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন আমাকে। তখন আমরা কেবল বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে এসেছি একসাথে। আপনি এবং ম্যাডাম আদর করতেন সেই সুবাদে। তিনি প্রথমেই বললেন, ‘আমাকে বাদ দিয়ে কর, তা নাহলে তোমরা কিছুই করতে পারবা না?’।
আমি স্পষ্ট করেই বললাম, ‘না স্যার, আপনাকে বাদ দিয়ে কিছুই করব না।’ তিনি বুঝিয়ে বললেন, আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র প্রতিনিধি নিযুক্ত করলেন। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম, রাজি হলাম। তবে স্যারের সাথে কথা বলেই কাজ শুরু করেছিলাম। কাগজে কলমে না থেকেও স্যারই ছিলেন প্রেরণা।
সুনামগঞ্জের হাওরে আমরা তখন নৌকায় ছৌয়ে বসে গল্প করছি ত্রাণ দিয়ে ফেরার পথে, হঠাৎ আম্মার ফোন। বললাম, ‘স্যারের সাথে আছি’। আম্মা বললেন, ‘কথা বলতে চাই’। বললাম, ‘স্যার, আম্মা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেন, কথা বলবেন?’
হাসতে হাসতে কথা বললেন। ইয়াসমিন ম্যাডাম নিজেও ফোন নিয়ে বললেন, ‘আমিও তোমার আম্মার সাথে কথা বলতে চাই।’ সেদিনের কথা খুব মনে পড়ে স্যার।
স্যার, শাবিপ্রবির বিখ্যাত নামকরণ আন্দোলনে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং আপনি ছিলেন মূল প্রতিপক্ষ। আমাদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়েছে সেই সুবাদে, তার পরেও গর্ব করেই বলতে চাই, আপনি এবং আমারা সেদিন মাথানত করিনি। আজও করবো না।
২৬ টা সেলাই আপনার গাঁয়ে দিয়েও আমরা লজ্জা নিবারনে ব্যর্থ হয়েছি স্যার। শুনেছি আক্রান্ত হয়েও আপনি দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমি ঠিক আছি, ওকে তোমরা মেরো না’।
স্যার, এই হামলা আপনি ব্যক্তির উপর নয়, চেতনার ওপর নগ্ন আক্রোশ থেকেই রচিত হয়েছে। আপনি একটা উপলক্ষ মাত্র।
৫৬ হাজার বর্গমাইল আজ আপনার রক্তে ধন্য হয়েছে। ১৯৭১ সালে আপনার বাবা জীবন দিয়ে যে শহীদ হয়েছিলেন। আমরা ঋণী ছিলাম, আপনি রক্ত দিয়ে তা শোধ করেছেন স্যার।
মৃত্যুর কাছে একজন ব্যক্তি জাফর ইকবাল আপনি তুচ্ছ। ক্ষয়িষ্ণু এই সময়ে আপনি আমাদের বিবেকের বাতিঘর।
স্যার, আপনি থামবেন না জানি। তবু এতুটুই বলব:
অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির
ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর…
স্যার, দ্রুত ফিরে আসুন। লড়াই এখনো শেষ হয়নি। ভয়, প্রলোভন কিংবা রক্তচক্ষু পায়ে দলে, বিবেকের দংশনে জ্বলে সত্য ভাষণে আপনিই আমাদের চেতনার সংশপ্তক।
ভালো থাকবেন স্যার। আবার দেখা হবে।
লেখক: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র