লোভ হতে সাবধান! আপনিও হতে পারেন এমন প্রতারণার শিকার
সাবধান! আপনিও হতে পারেন এমন প্রতারণার শিকার। রংপুরে যেভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছিল ৩৫ লাখ টাকা।
কিছুদিন আগে রংপুরে ভিন্ন দুইটি ঘটনায় দুইজন ব্যক্তি প্রতারকের ফাঁদে পা দিয়ে ৩৫ লাখ টাকা খুইয়েছেন। তাদের একজন মসজিদের ইমাম অন্যজন ব্যবসায়ী। ঘটনা দুইটি শেয়ার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই দুটি ঘটনার মাধ্যমে অন্যরা যেন সচেতন হয়,এমন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব না হয়।
ঘটনা-১
প্রথম ঘটনাটি ঘটে একজন মসজিদের ইমামের সাথে। ঘটনার প্রায় ১৫-২০ দিন আগে এক প্রতারক এসে ইমাম সাহেবের সাথে পরিচিত হয়ে এক মাদ্রাসায় এক লাখ টাকা সহযোগিতা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে সেই প্রতারক ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করে কথা বলে ধীরে ধীরে বিশ্বস্ততা অর্জন করে।
এর মাঝে সেই প্রতারক ইমাম সাহেবকে জানায়, তার কাছে বাংলাদেশি টাকায় পাঁচ লাখ টাকার মত রিয়েল আছে। কিন্তু সেগুলো তিনি ভাঙ্গাতে পারছেন না। কারণ ব্যাংক থেকে উক্ত টাকা ভাঙ্গাতে গেলে যে ভিসা দরকার তা তার কাছে নেই।
তাই তিনি ইমাম সাহেবের সহযোগিতা চাইলেন তিনি যেন তা একটু ব্যবস্থা করে দেন। আর টাকাটা ভাঙ্গাতে পারলেই তিনি সেখান থেকে ১ লাখ টাকা মাদ্রাসায় দান করে দিবেন।
বলে রাখা ভালো, ইমাম সাহেবের কথা বার্তায় বুঝা গেছে তিনিও মানি এক্সচেঞ্জ এর ব্যবসার সাথে জড়িত। তাই কিছু লাভের আশায় এবং খুব সহজেই নির্ধারিত দিনে এবং সময়ে পাঁচ লাখ ম্যানেজ করলেন। সেই প্রতারকও আরও কয়েকজন লোকসহ সুন্দর করে একটা কাপড়ের পোটলা/প্যাকেট বানিয়ে তার মধ্যে বিদেশি রিয়েল নিয়ে আসলেন।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ইমাম সাহেব একটা অটোতে উঠলেন। সাথে ওই প্রতারক এবং তার সাথে লোকজনও। অটোতে বসেই প্রতারক চক্র সেই কাপড়ের পোটলার ভেতর থেকে ইমাম সাহেবকে কয়েকটা বিদেশি রিয়েলের নোট বের করে দেখালেন যাতে তিনি মনে করেন এর ভেতরে সবগুলোই বিদেশি রিয়েল। ইমাম সাহেবও তাই বিশ্বাস করলেন। এবং যেহেতু আশপাশে লোকসমাগম বেশি তাই এভাবে সবগুলো রিয়েল বের করতে না করলেন, যাতে আবার অন্য কোনো সমস্যা না হয়।
হুজুর সরল মনে অটোতে বসে টাকা আর বিদেশি রিয়েল রাখা কাপড়ের ব্যাগের প্যাকেট হাত বদল করে নিলেন। কিছুক্ষণ পর প্রতারক চক্র সালাম কালাম দিয়ে ইমাম সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অটো থেকে নেমে গেলেন। আর হুজুর সাহেবও বিদেশি রিয়েলসহ কাপড়ে মোড়ানো প্যাকেটটি নিয়ে বাসায় চলে আসলেন।
ইমাম সাহেবের এইটুকু কনফিডেন্ট ছিল যে, যেহেতু তার মোবাইল নাম্বার তার কাছে আছে তাই কোন প্রকার দুই নাম্বারির সুযোগ নেই। কারণ মোবাইলের সূত্র ধরে তো তাকে বের করা সম্ভব।
বাসায় এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ইমাম সাহেব যখন কাপড়ের প্যাকটটি খুললেন তখন তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কারণ সেখানে রিয়েলের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। যা আছে তা হচ্ছে একটা বিছানার চাদর, একটা লুঙ্গি আর গামছা যা সুন্দর করে ভাজ করে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বিদেশি রিয়েলের পাঁচ লাখ টাকা সমমূল্যমানের প্যাকেট হিসেবে ইমাম সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়ে বিনিময়ে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
তৎক্ষণাৎ ইমাম সাহেব ওই প্রতারক ছেলের নাম্বারে ফোন দিলেন। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো দুঃখিত, আপনি যে নাম্বারটিতে কল করেছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে। নাম্বারটি সেই যে বন্ধ হয়েছে এখনো বন্ধ। আর কোনদিন চালু হবে কি না একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানে। চক্রটিকে শনাক্ত করতে কাজ করছে পুলিশ।
ঘটনা-২
দ্বিতীয় ঘটনাও রংপুরের এবং তা আগের ঘটনার কয়েকদিনের পরেই ঘটে। ঘটনার ভোক্তভোগী একজন ব্যবসায়ী। প্রায় মাস দেড়েক আগে হঠাৎ একদিন অপরিচিত এক ব্যক্তি একজন বিদেশিসহ উক্ত ব্যবসায়ীর দোকানে এসে হাজির হন।
তিনি জানান, বিদেশি ভদ্রলোক রংপুরে একটি ইন্ড্রাস্টি করতে জমি খুঁজছেন। তিনি যদি তাকে সহযোগিতা করেন তাহলে লাভবান হবেন। তিনি তাকে বুঝালেন বিদেশিকে ভুল ভাল বুঝিয়ে জমির দাম কম বেশি করে বিদেশির কাছ থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নেওয়া যাবে।
কথা মত কাজ শুরু হলো। এবার টাকা লেনদেনের সময় আসলো। বিদেশিসহ অপরিচিত লোকটি ব্যবসায়ীর বাসায় আসলেন। অপরিচিত লোকটি ব্যবসায়ীকে আশ্বস্ত করলেন যে তারা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের ডলার নিয়ে আসছেন এবং তার পুরোটাই তার কাছে রেখে যাবেন। বিনিময়ে তাকে ৩০ লাখ টাকা আপাতত যোগাড় করে দিতে হবে। বাদ বাকি টাকা জমির কাগজপত্র করার সময় হিসেব নিকাশ করা হবে।
ব্যবসায়ী টাকা যোগাড় করলেন এবং তাদের কথা মত সবগুলোই এক হাজার টাকার নোট। নির্ধারিত দিনে বিদেশিসহ অপরিচিত লোকটি ব্যবসায়ীর রংপুরের বাসায় আসলেন। ব্যবসায়ী লোকটি ত্রিশ লাখের জায়গায় ২৮ লাখ টাকা যোগাড় করতে পারলেন এবং কথামত সবগুলো এক হাজার টাকার নোটই যোগাড় করলেন।
ব্যবসায়ীর সামনে বিদেশি লোকটি তার সাথে নিয়ে আসা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের ডলারের বাক্স থেকে দুটো নোট বের করলেন এবং সেই নোট দুটি ভাঙিয়ে ব্যবসায়ী লোকটিকে পরীক্ষাও করে নিলেন যে ডলারগুলো আসল।
এবার ব্যবসায়ীর ২৮ লাখ টাকার নোটগুলো সেই অপরিচিত লোকটি সাদা কসটেপ দিয়ে খুব সুন্দর করে পেঁচালেন। আর তাদের সাথে নিয়ে আসা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের বিদেশি ডলারের বিশেষ বাক্সসহ ব্যবসায়ীর হাতে দিয়ে বললেন এই সবগুলোই আপনার কাছে থাক। আমরা আগামীকাল এসে বাদ বাকি কাজ করব।
ব্যবসায়ী তো মহাখুশী। এমন সহজ সরল মানুষ এই দেশে কজন আছে। সেখানে আবার বিদেশি বলে কথা। মহাখুশি মনে ব্যবসায়ী লোকটি বিদেশিদের আপ্যায়ন করে বিদায় দিলেন। আর রুমে এসে টাকা এবং ডলারের বিশেষ সুরক্ষিত বাক্সটি আলমারিতে যত্ন করে রাখলেন।
অপরিচিত লোকটি ঢাকায় গিয়ে পরের দিন ব্যবসায়ীকে ফোন দিলেন। বললেন, ইমার্জেন্সি তিন লাখ টাকা লাগবে এবং দ্রুত বিকাশে উক্ত টাকা পাঠাতে বলেন। এমন বিশ্বস্ত মানুষের ডাক পেয়ে কি বসে থাকা যায়। আশপাশের যত বিকাশ এজেন্টের দোকান ছিল সবার দোকান থেকে বিভিন্ন নম্বরে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠালেন।
এর ঠিক এক দিন পরেই ব্যবসায়ী লোকটি যখন সেই অপরিচিত লোকটিকে ফোন দিলেন দেখতে পেলেন নাম্বারটি বন্ধ। ভাবলেন হয়তো অন্য কোন কারণে নাম্বারটি বন্ধ আছে। ঠিকই নাম্বার খুলবে। বাট তিন দিন পার হয়ে যায় নাম্বার আর চালু হয় না। আর তার কাছে রাখা ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের বিদেশি ডলারেরও কোনো খোঁজ কেউ নেয় না।
বেশ ভাবনার মধ্যে পড়ে যায় ব্যবসায়ী লোকটি। এতোগুলো ডলার কি করবে! কাউকে জানাবে নাকি একা একাই সেগুলো নিয়ে নিবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। বুঝে উঠতে পারছিল না যে সেদিন তার ২৮ লাখ টাকার যে প্যাকেটটি তারা কসটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে প্যাকেট করেছিল সেটি কৌশলে সরিয়ে অন্য একটি অনুরূপ প্যাকেট তাকে দিয়ে গেছে।
সেই বিদেশি এবং অপরিচিত লোকটির সাথে প্রায় বেশ কিছুদিন যাবৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর নিরুপায় হয়ে ব্যবসায়ী লোকটি তার ২৮ লাখ টাকার কসটেপ দিয়ে মোড়ানো প্যাকেটটি খুললেন। আর যা দেখলেন তা দেখেই তাৎক্ষণিক অজ্ঞান হয়ে গেলেন। লোক ডেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে।
ব্যবসায়ীর কাছে থাকা কসটেপ দিয়ে মোড়ানো প্যাকেটে কোন টাকা ছিল না। যা ছিল সবই এক ধরনের কালো কাগজ। আর অপরিচিত লোকটির রেখে যাওয়া ১৫ কোটি টাকা মূল্যমানের বিদেশি ডলার এর বিশেষ বাক্সটি বহু কষ্ট করে ভাঙার পর সেখানেও পাওয়া গেল একই ধরনের এক ধরনের বিশেষ কালো কাগজ।
আমার কিছু কথা: দুটো ঘটনার ভোক্তভোগীর সাথে কথা বলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে অপরিচিত লোকদের কোন প্রকার পরিচয় না জেনে তাদের এভাবে বিশ্বাস করার কারণ কি?
উত্তরে জানিয়েছিল, তাদের ফোন নাম্বারের কথা। তাদের ধারণা ফোন নাম্বার যেহেতু আছে সেহেতু পরিচয় গোপন করার কোন সুযোগ নেই। কারণ তারা যেমন আঙুলের ছাপ দিয়ে ফোন নাম্বার নিবন্ধন করেছেন এরকম তো সবাই করেছেন।
কিন্তু তাদের এই বিশ্বাসে মধ্যে যে অনেক বড় একটা গ্যাপ আছে তা হয়তো অনেকেই জানে না। আর এই সুযোগটি নিয়েই মোবাইলের মাধ্যমেই ঘটছে ভয়াবহ সব প্রতারণা। অথচ বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের ফলে এই মোবাইল নাম্বারটি হওয়া উচিৎ ছিল একজন মানুষের আইডেন্টিটি।
এক্ষেত্রে সরকারের হয়তো আন্তরিকতার কমতি ছিল না।কিন্তু আমরাই তার মিস ইউজ করেছি। নানা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছি। বায়োমেট্রিক এর অপপ্রয়োগ ঠেকাতে সরকার যখন গ্রাহকদের এনআইডির বিপরীতে তাদের অজ্ঞাতসারে নিবন্ধিত সিমগুলো বন্ধ করে বার বার প্রচারণা চালিয়ে অনুরোধ করল তখন কজন এই কাজটি করেছেন বলবেন?
আপনি কি দেখেছেন আপনার নামে আপনার অজ্ঞাতসারে কোন সিম নিবন্ধিত আছে কি না? এখন যদি এরকম কোন সিম দিয়ে কোন ক্রাইম হয় তার দায়ভার এড়াবেন কিভাবে?
আর একটি অনুরোধ,দয়া করে লোভে পড়ে যাচাই বাছাই না করে কখনোই পুরাতন মোবাইল কিনবেন না। এমনকি অনলাইন মার্কেট থেকে তো নয়ই। এমন হতে পারে ওই মোবাইল দিয়ে এমন কোন ক্রাইম হয়েছে যার দায়ভার আপনার উপর বর্তাতে পারে। আর এরকম ঝামেলায় একবার জড়িয়ে গেলে তখন বুঝবেন লাইফটা কিভাবে হেল হয়ে যায়।
বিকাশে লেনদেনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ অনিয়ম হচ্ছে। এজেন্টরা টাকা দেওয়ার সময় কারো কোন প্রকার আইডি বা পরিচয়পত্র রাখেন না। ছোট খাট লেনদেনের বিষয়টা না হয় ভিন্ন বাট ১০ হাজার টাকার উপর লেনদেন হলে তো আপনাকে নিয়ম মেনে লেনদেন করা উচিৎ। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। কিছু মানুষকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন অথবা তাকে দেখে যদি অন্যদের শিক্ষা হয় সেটাই করা উচিৎ।
আর শুধুমাত্র মোবাইল নাম্বারের পরিচয় দিয়ে কারো সাথে কোনপ্রকার লেনদেন করবেন না। লেনদেন করার সময় অবশ্যই সাথে সাথে আপনার প্রাপ্য দেখে শুনে বুঝে নিবেন। বড় কোন লেনদেনের ক্ষেত্রে পরিচিতজনের সাথে পরামর্শ করবেন, সহযোগিতা নিবেন।
লোভে পড়ে রাতারাতি কোটিপতি হবার স্বপ্ন দেখবেন অথবা নিজেকে অন্যের চেয়ে চালাক ভাবলে পুরস্কার হিসেবে কখন যে কপালে এরকম দুর্গতি নেমে আসে ভাবতেও পারবেন না। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু অথবা অতি চালাকের গলায় দড়ি চিরন্তন সত্য এই কথাগুলো মনে রাখবেন।
লেখক: সাব ইন্সপেক্টর, পিবিআই, রংপুর জেলা।