দেড় বছর পূর্বে রাজশাহীর আবাসিক হোটেলে জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটন
আবাসিক হোটেলে প্রেমিককে হত্যার পর প্রেমিকাকে পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যা
লোক লোকান্তরঃ আবাসিক হোটেলে প্রেমিককে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রেখে প্রেমিকাকে পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। হোটেলে তরুণ-তরুণীর লাশ উদ্ধারের দেড় বছর পর তাদের হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন দুই যুবক। তারা হলেন রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজের ছাত্র আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০) এবং রাজশাহী কলেজের ছাত্র বোরহান কবির উৎস।
এ ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ ও রাজশাহী কলেজের ছাত্র আল আমিন নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
গত বছরের ২২ এপ্রিল রাজশাহী নগরীর নাইস হোটেলের একটি কক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমান মিজান এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের ছাত্রী সুমাইয়া নাসরিনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
ওই দিনই সুমাইয়ার বাবা আবদুল করিম বাদী হয়ে নগরের বোয়ালিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-এর এসআই মহিদুল ইসলাম জানান, গত ১৮ ও ১৯ অক্টোবর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা এ চারজনকে গ্রেফতার করেন।
গত সোমবার রাজশাহী মহানগর হাকিম জাহিদুল ইসলামের আদালতে রনি এবং কুদরাত-ই-খোদার আদালতে উৎস ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় প্রতিশোধ নিতে মেয়েটিকে ধর্ষণ এবং তাকেসহ তার প্রেমিককে হত্যার ঘটনা ঘটানো হয় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়, বলেন মহিদুল।
রনির জবানবন্দির বরাত দিয়ে মহিদুল বলেন, নাইস হোটেল কক্ষে মিজানুরকে প্রথমে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর তারা সমুাইয়াকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। পুলিশের মেয়ে বলে ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে তারা তাকেও মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে।
এসআই মহিদুল বলেন, রাহাত মাহমুদের সঙ্গে প্রথমে সুমাইয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে মিজানুরের সঙ্গে নতুন করে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। এ নিয়ে রাহাত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন। রাহাত নগরের বিনোদপুরের একটি ছাত্রাবাসে থাকতেন। সেখানে তিনি আহসান হাবিবকে ডেকে নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলেন। মিজানুরকে চিনতেন আহসান হাবিবও।
মহিদুল বলেন, এরইমধ্যে মিজানুরের সঙ্গে দেখা করতে সুমাইয়া রাজশাহীতে আসছিলেন। মিজানুর তাকে নাটোরের বনপাড়া থেকে এগিয়ে নিয়ে আসেন। সে সময় আহসান হাবিবকে ফোন করে মিজানুর হোটেলের খবর জানতে চান। পরে হাবিবের পরামর্শে মিজানুর ও সুমাইয়া নাইস হোটেলে ওঠেন। এরপর এই চার যুবক হোটেলের ওই কক্ষে ঢুকে সুমাইয়াকে পান।
তারপর তারা চাপ প্রয়োগ করে সুমাইয়াকে দিয়ে ফোন করিয়ে মিজানুরকে ডেকে আনান। মহিদুল জানান, মিজান রুমে আসার পর তার সঙ্গে রাহাতের কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে রাহাত টি টেবিলের পায়া খুলে মিজানের মাথায় আঘাত করেন। এতে তার মাথা ফেটে যায়। পরে সুমাইয়ার ওড়না দিয়ে গালায় ফাঁস দিয়ে রাহাত ও রনি মিজানকে হত্যা করেন। তারপর পর্যায়ক্রমে রাহাত, রনি ও আল আমিন সুমাইয়াকে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণের পর রনি সুমাইয়াকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে রাহাত ও রনি দুইজনে মিলে সুমাইয়ার মুখে বালিশ চেপে ধরে হত্যা করে এবং মিজানের লাশ রনি ও রাহাত ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন। এরপর রনি দরজা দিয়ে এবং অন্যরা জানালা দিয়ে বের হয়ে যান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহিদুল বলেন, রাজশাহী নগরের বোয়ালিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সেলিম বাদশা মামলাটি তদন্ত করেন। তবে পাশাপাশি মামলাটির ছায়া তদন্ত করছিল পিবিআই। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি আদালতে সেলিম বাদশার দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, সুমাইয়াকে ধর্ষণের পর হত্যা করে মিজানুর রহমান আত্মহত্যা করেছেন।
মহিদুল বলেন, গ্রেফতার চার জনের মধ্যে রনি ও উৎসব আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা স্বীকার করেছে। রাহাত ও আল আমিনকে আবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
মহিদুল আরও জানান, আহসান হাবিব রনি রাজশাহীর বরেন্দ্র কলেজের ছাত্র হলেও ঘটনার পর থেকে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। গত ১৮ অক্টোবর তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার দিন রনি ও নিহত মিজানুরের একটি ফোন কলের সূত্র ধরে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন রাজশাহী নগরের একটি ছাত্রাবাস ও সোনাদিঘী এলাকা থেকে রাহাত মাহমুদ, আল আমিন ও উৎসকে গ্রেফতার করা হয়। রনি পাবনার ফরিদপুর উপজেলার এনামুল হক সরদারের ছেলে। রাহাতের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার খোর্দ্দ গজাইদ গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে। আল আমিন রাজশাহীর পবা উপজেলার জয়কৃপুর গ্রামের টিপু সুলতানের ছেলে এবং উৎসব নাটোরের লালপুর উপজেলার উত্তর লালপুর গ্রামের শফিউল কালামের ছেলে। নিহত মিজানুর রহমান সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গা থানার পাঠানপাড়া দক্ষিণগঞ্জের মো. ওমেদ আলীর ছেলে এবং সুমাইয়া সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা থানার চক চৌবিলা গ্রামের মো. আবদুল করিমের মেয়ে।