হার না মানা মোসাদ্দেকের মা
লোক লোকান্তর : মূল দরজায় ‘মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত’ নামের নিচে লেখা ‘৩২’। বাড়ির নম্বর ভাবলে ভুল করবেন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ক্রিকেটার মোসাদ্দেক, জার্সির নম্বরই তো তাঁর ঠিকানা!
এই যে মাত্র ২১ বছর বয়সী এক তরুণকে সারা দেশের মানুষ একনামে চিনে ফেলল, এর পেছনে বড় অবদান কার? প্রশ্নের উত্তরে মোসাদ্দেক সব সময় বলে এসেছেন মায়ের কথা।
সেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতেই এক সন্ধ্যায় হাজির হই ময়মনসিংহের এই অলরাউন্ডারের বাড়িতে। ক্রিকেট মাঠে মোসাদ্দেককে লড়াই করতে আমরা দেখেছি। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝলাম, বড় লড়াকু তো তিনিই!
মোসাদ্দেকের বাবা আবুল কাশেম ময়মনসিংহ জেলা ক্রীড়া সংস্থায় চাকরি করতেন। তাঁর খুব শখ ছিল, ছেলেদের বড় ক্রিকেটার বানাবেন। খুব আগ্রহের সঙ্গে তিন ছেলেকে মাঠে নিয়ে যেতেন। ব্যাট, প্যাড, জুতা কিনে দিতেন। সব ভন্ডুল হয়ে গেল ২০০৮ সালে।
বাবাকে হারালেন নবম শ্রেণি পড়ুয়া মোসাদ্দেক। ছোট দুই যমজ ভাই মোসাব্বের হোসেন আর মোসাদ্দের হোসেন তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের দায়িত্বের কথা ভেবে মোসাদ্দেক ধরেই নিয়েছিলেন, ক্রিকেটটা বোধ হয় আর খেলা হবে না। পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে হারিয়ে তখনো হাল ছাড়েননি মোসাদ্দেকের মা হোসনে আরা বেগম। ঠিক করেছিলেন, স্বামীর স্বপ্ন তিনি অপূর্ণ রাখবেন না।
‘আমাদের একটা জমি ছিল। জমি বিক্রি কইরা ছোট দুই ছেলেরে বিকেএসপিতে ভর্তি করলাম। ছেলেপেলেরা ছোট, আমি একলা মানুষ। জমি বিক্রি করা তো সহজ না। অনেক কষ্ট হইসে।’ হোসনে আরা বেগম অল্প কথায় পুরো ঘটনা বলে ফেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমাদের তো আরও জানার আগ্রহ। জানতে চাইলাম, ‘আগে তো বাবাই ছেলেদের এখানে-সেখানে খেলতে নিয়ে যেতেন।
কিন্তু পরে…?’ মা এই প্রশ্নেরও উত্তর দিলেন ছোট্ট করে, ‘ওরা নিজেরাই সব করসে, আমার কিছু করতে হয় নাই।’স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বাপহারা ছেলেদের মানুষ করেছেন মা, আর তাঁদের ঠিক পথে রেখেছে ‘ক্রিকেট’। একজন বলছিলেন, ‘মোসাদ্দেকদের বাড়ির আশপাশের অনেক ছেলেপুলে কিন্তু নেশা করে নষ্ট হয়ে গেছে। ওরা তিন ভাই খেলার মধ্যে ছিল বলে খারাপ কিছু ওদের ধরতে পারে নাই।’
ছোট দুই ভাই অবশ্য ক্রিকেটের পাশাপাশি বড় ভাইকেও কৃতিত্ব দিতে চান। বলছিলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আসলে বড় ভাই-ই আমাদের বাবার মতো। ভাইয়ার বন্ধুরা বলবে, “তোর ভাইরে তো দেখলাম অমুকের সঙ্গে”—এই ভয়ে খারাপদের সঙ্গে যেতাম না। এখনো রাত ১০টার আগে বাসায় ফেরার চেষ্টা করি। আমরা বড় ভাইকেই ভয় পাই।’
মাঠে মোসাদ্দেক যখন ছক্কা পেটান কিংবা উইকেট নিয়ে সতীর্থদের সঙ্গে উদ্যাপনে মেতে ওঠেন, সারা দেশের মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে। তবে মায়ের আনন্দ কিন্তু সবার চেয়ে আলাদা। দুরু দুরু বুকে তিনি ছেলের খেলা দেখেন। বলছিলেন, ‘মাঠে নামার আগে সব সময় ছেলে আমারে ফোন দেয়। বলে, “মা আমি মাঠে যাচ্ছি। দোয়া কইরো।” আমি বলি, বাবা, বিসমিল্লাহ বইলা নামিস।’
বড় ভাইয়ের পথে এগোচ্ছেন ছোট দুই ভাই। দুজনই অলরাউন্ডার। একজন খেলেন শেখ জামাল ক্লাবে, আর আরেকজন কলাবাগানে। মায়ের কাছে প্রশ্ন করি, ‘বড় ভাইয়ের মতো ছোট দুই ভাইও জাতীয় দলের জার্সি পরবে, এমন স্বপ্ন কি দেখেন?’ এতক্ষণ সব প্রশ্নে ছোট ছোট উত্তর দিয়ে যাওয়া হোসনে আরা বেগমের মুখ এবার ঝলমল করে ওঠে। বলেন, ‘তাইলে আমার চেয়ে খুশি আর কে হইব!’
সূত্র : প্রথম আলো