| বিকাল ৪:৫১ - শুক্রবার - ১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ৮ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি

ময়মনসিংহের অন্যতম আকর্ষণ ঐতিহ্যবাহী ‘শশী লজ’

ফাহিম মোঃ শাকিলঃ   ময়মনসিংহের জমিদারদের যে সকল স্থাপনা এখনো পর্যটকদের কৌতুহল জাগায় তার মধ্যে শশী লজ (বর্তমানে মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ) তাদের মধ্যে অন্যতম।

 

পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত ‘শশী লজ’ জমিদার আমলের এক অনন্য স্থাপনা । এই শশী লজ মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের বাড়ী, যা ময়মনসিংহের রাজবাড়ী নামেও খ্যাত।

 

মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নির্মান করেছিলেন এক মনোরম প্রাসাদ। এ প্রাসাদটি ‘ক্রিস্টাল প্যালেস’ বা ‘রংমহল’ নামেও পরিচিত ছিলো।

 

১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিখ্যাত ‘রংমহল’ ধ্বংস হয়ে গেলে সেই স্থানে নির্মান শুরু করেন বাইজেন্টাইন ধাঁচের বর্তমান ভবনটি। ভবনটির নির্মান সম্পন্ন হওয়ার আগেই সূর্যকান্ত আচার্য মত্যুবরণ করেন। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ভবনটির নির্মান শেষ করেন ১৯০৫ সালে এবং তাঁর নাম অনুসারে এর নামকরণ করেন ‘শশী লজ’।

 

জানা যায়, শশীকান্ত  নির্মিত শশী লজ এখনো অনেকর মনে বিস্ময় জাগায়। তিনি রাজা থেকে মহারাজা পর্যন্ত উপাধি পেয়েছিলেন। ১৯২০ সাল (বাংলা) , বাংলার গভর্ণর রোনাল্ড তাকে মহারাজা উপাধি দেন। তিনি ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ বংশের জমিদারদের জন্যই ময়মনসিংহ শহর জমিদারদের শহর বলে পরিচিত। দৃষ্টিনন্দন শশী লজ এঁদেরই কীর্তি।

পুরো বাড়ীটি ৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। শশীলজের মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। সর্বমোট ২৪ টি কক্ষ রয়েছে এই ভবনটিতে।  ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ঝুলন্ত, প্রায় একই রকম দেখতে, ঝাড়বাতি। শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাগান।

 

বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে রয়েছে গ্রিক দেবী ভেনাসের মূর্তি। শশী লজের ভেতরের বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গশালা। সুদৃশ্য সেই রঙ্গশালার এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। ভবনটির পেছনে উঠান। সবুজ ঘাসের সেই উঠান পেরোলে একটি জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পারে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ।

 

মূল ভবনের পেছনভাগে রয়েছে একটি দোতলা স্নানঘর। কথিত আছে এই স্নানঘরে বসে রানী পাশের পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। এছাড়াও অর্ধ গোলাকার খিলান সম্বলিত প্রধানপ্রবেশ পথটি শশী লজের স্থাপত্যিক সৌন্দর্য বাড়তি শোভা যোগ করেছে।  বাড়িটির আশেপাশে এখনো রয়েছে বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য ও প্রচীন গাছগাছালি।  আছে দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গম যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

 

বাড়িটিতে বেশ কিছু স্নানঘর  রয়েছে। এক স্নানঘরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। ধারণা করা হয় এই সুড়ঙ্গপথেই গোপনে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। উল্লেখ্য, মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতেও এই রকম একটি সুড়ঙ্গপথ পাওয়া যায়।
এই শশীলজেই ধারণ করা হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক অয়োময়-এর পর্বগুলো, যা বিটিভিতে প্রচারিত হযয়েছিল। নাটকে এটি ছিল জমিদারের বাড়ি। মূলত এই নাটকের পরিচিতির পরেই স্থানীয়দের কাছে বাড়িটি “জমিদারবাড়ি” হিসেবে পরিচিতি পায়। এছাড়াও রাখাল বন্ধু নামে আরেকটি ধারাবাহিক নাটকের শ্যুটিংও এই বাড়িটিতে হয়েছিলো।

 

ময়মনসিংহে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন মহারাজ শশী কান্তের আমন্ত্রণে। ১৯২৬ সালের ফেব্রয়ারি মাসে কবি ময়মনসিংহে আসেন । ১৯ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত কবি আলেকজান্দ্রা ক্যাসেলে অবস্থান গ্রহন করেন।

 

১৯৫২ সাল থেকে শশী লজ ব্যবহূত হচ্ছে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৯ সালে ‘শশী লজ’ কে সংরক্ষিত স্থাপনা হিসেবে ঘোষনা করে এবং এখানে একটি জাদুঘর নির্মানের প্রকল্প নেয়া হয়।  বর্তমানে এটি ‘মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সর্বশেষ আপডেটঃ ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ | জানুয়ারি ২৩, ২০১৭