| রাত ৯:৫৭ - রবিবার - ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

লোক লোকান্তর সাহিত্য

লোক লোকান্তর ডেস্কঃ   স্টিফেন ফিলিপস ও রবীন্দ্রনাথ নামক এক প্রবন্ধে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন “ সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়- সাহিত্যও অমর হয় না। রাষ্ট্রে- রাষ্ট্রে জাতীয় গ্রন্থাগারে কালাতিক্রম করে যাঁদের সু-সজ্জিত দেখা যায়, তাঁদের অনেকেই আজ আধুনিক পাঠকদের কাছে অপরিচিত। তবে, যে কয়টি সাহিত্যকণাকে কালের কষ্টিপাথরে পরখ করে খাঁটি সোনা বলে জহুরী- পাঠকরা গ্রহণ করেছেন- তাঁরা কালজয়ী স্রষ্টা। কিন্তু, অমরতা লাভের গৌরব ক’জন দাবি করতে পারেন? কাব্যের রস, গদ্যের তত্ত্ব, অভিনয়ের আঙ্গিক কালবদলের হাওয়ায় নূতন মানুষের তৃপ্ত করে না। রস ও রুচির মৃত্যু হয়, তত্বেরও সমাধি হয়। সাহিত্য কলা বিজ্ঞানের দীর্ঘ পথে ছাড়িয়ে আছে রসের পঙ্ক, ভাবের কঙ্কালরাশি। কত কবি- মনীষীকে অবজ্ঞাভরে বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে দিঙনাগাচার্যর দল। আবার অন্যযুগে মুষ্ঠিমেয় রসিকের দল তাদের পুর্নবাসন করেছেন।”
কবিতা যাত্রার নিরন্তর পথ গন্তব্য ঠিকই খুঁজে নেয়; আগে কিংবা পরে বা অন্য সময়ে। সময়ের আয়োজনে কাব্য চিন্তা কখনো কখনো মহৎ হয়ে ওঠে প্রান্তজনের কাছে  রস, কস ও মুক্তচিন্তার ব্যাকুলতায়। আশরাফ জুয়েল একজন কবি। কবিতা রচনা ও নির্মাণের অনায়াস দক্ষতা বগলের তবলার মতো তিনি বাজাতে পারেন সূর্যকে সাক্ষী রেখে। কবিতা রচনা ও নির্মাণ নিয়ে আছে জটিল আলোচনা। জটিল আলোচনার বক্ষ তীব্রতীক্ষ্ম গতিতে ভেদ করে এক্সনকারের সাথে সময়ের পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে কবি আশরাফ জুয়েলের কাব্যচর্চা। এই ছুটে চলা বলে ছুটে আছেন অনেক আগে থেকেই, সেটা ধ্যান ও জ্ঞানে, মনে ও প্রাণে। তবে, আত্মা ও আড্ডার বাইরে নয়। সুন্দরের পূজারী হয়ে সুন্দরকে ম্পর্শ করেছেন মানবিকবোধের ভেতর থেকে। যোগ্য মালি কবিতার বাগানে পানি তুলে চলেছেন রোজ।
কেউ কেউ বলেন, কবিতা দূর্বোধ্য, যাদুবাস্তবতাময়, অটোমেটিক রাইটিং বা বিমূর্ততা। সুন্দরের মোটিফ সংকলন। এসবের ভেতরে প্রয়োজনটুকু সংগ্রহ করেÑ কিংবা আনন্দঘন মুহূর্তÑ পর্যন্ত কবিতা আমার কাছে দেবতার দলিল। আবার আনন্দ উধাও হয়ে যাবার পরক্ষণেই কবিতা অবাস্তব ও উদভ্রান্ত ছাড়া কিছুই নয়। কবিতার বিমূর্ততা বা দূর্বোধ্যতা আমার উপকরণ বা উপলক্ষ্য নয়। সুন্দরের রস সাধনা করাই দেবতাজ্ঞান করি। আর এসবের সম্মিলিত রূপের প্রয়াসই যেন কবি আশরাফ জুয়েলের ‘যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব’ একটি শৈল্পিক ক্যানভাস। তার সন্ধির অনুচ্ছেদে দেখা যায়,
না মানা নিয়মেই বুড়ো হয় রাত,
সন্ধির অনুচ্ছেদে পড়েছে শেল।
খুনসুটিতে ঘুম ভাঙে চেনা শালিকের,
গতরাতে ঢেঁকি ভাঙার আওয়াজ শোনা গেছে নিরন্তর।
সুখ ও পথিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে
পাথুরে চোখ পথ খোঁজে পথিক।
‘কিছু সিডেটিভ লেগে আছে রাতটার জিভে’ কবিতার মধ্যলাইনে আওয়াজ তোলেÑ
‘আম্বুলেন্স গলা ফাটিয়ে দেশটাকে নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে অজানার পথে। আমার আঙুলে নিয়নের খিটখিটে মেজাজ, পানের পিক ফেলে হাঁটছে, পিক নয়, ওগুলো রক্তবমি, আল্পনা আঁকছে নিজের শরীরেই।এখন ফ্লুরেসেন্ট আর নিয়নে গালাগালি।
সত্যিই তো সময়ের মিথ্যা সাইকেলে চড়ে আমরা অজানার পথে হাঁটছি ক্রমান্বয়ে সত্য ও সুন্দরকে দূরে ঠেলে বহু দূরে চলে যাচ্ছি। এই চলে যাওয়া ফিরে আসার জন্য নয়। বরং সামনে মিথ্যা রক্তবমি যা দিয়ে ভুলমানুষ শরীরে আল্পনা আঁকছে। সেখানে নিরন্তর দু’দলের গালাগালি। আর সেখানে একজন কবি সময়ের একজন সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষক মাত্র।
‘যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব’ নিয়ে এর পেটে যখন ক্রমান্বয়ে ভ্রমাণানন্দ করছি, তখন তার আরো গভীরে প্রবেশ করে খুঁজে পাই নিখুতের অনুসন্ধানÑ ‘মাফ করবেন মহাশয়’ সময়ের দারুণ ব্যঞ্জনা। যা কিছু সুবিধাভোগি মানুষেরগালে কড়া চপেটাঘাত। যখন উচ্চারিত হয়Ñ
হুজুর বেয়াদবি নেবেন না, এবার যে ঘরে ফিরতে হয়
পেটে পাথর বেঁধে মিছিলে স্লোগান দিতে আর পারব না।
এই কবির উপলব্ধিমূলক কবিতাগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল, অঙ্কবিদ, মৃত্যুঘ্রাণ, সবুজাভ, মেয়েটি, যার স্তনের বোঁটা গাঢ় লাল, আমরা ভাত গণনা করেছি মহাআক্রোশে, প্রায়ান্ধ চোখের বিলাপ, স্মৃতিদীর্ণ গোপনবার্তা, ট্রিগার ও ভীষণ একটা ছবি। যা বোধের দরজা খুলে পুরো শহর নাড়া দেয়। সুন্দর অনুসন্ধানে ব্যস্ত। পরাবাস্তবতার দিকে কবির আগ্রহ থাকলে বাস্তবতার স্মৃতিচিহৃগুলো সমান উজ্জ্বল। সমসাময়িক বিষয়াবলী, যাপিন জীবন, বেদনার সুর, চলন্ত সিঁড়ি অথবা গিটারের সুরের মতোই আশরাফ জুয়েলের কবিতা চেনা পথের সঙ্গী।
খটকা লেগে যায়, ‘প্রেমে আমার বিশ্বাস লুট হয়েছে বগযুগ আগে’ কবিতায়
শালুক তুলতে গিয়ে পা ফসকে
পাড়ে যাচ্ছিলাম গভীর জলে,
হাত বাড়াসনি?
অথচ শুধু চেয়েছিলাম তোর দৃষ্টির প্রশ্রয়।
আমার কাছে কিছুটা দূর্বোধ্যতা মনে হল। অসামঞ্জস্যতা খেলা করছে বেশ। জাম্পিংই বেশি। অ্যাবসার্ড বলতে পারে। আমি বলব দূর্বোধ্য। সহজ হতে হবে এমন নয়, কিংবা এমনটা বলছিও না। এমন আরো কয়েকটি কবিতা রয়েছে। এখানে হয় তাড়াহুড়ো ছিল। অথবা অন্যকিছু বুঝাতে চেয়েছেন রূপকার্থে।
তবে, কবির শক্তিমত্ত্বার দিকটা হল, ভিন্নভিন্ন চিন্তার অনুষঙ্গকে একত্রিত করে নতুন শব্দে কাব্য বুনন। শব্দের শরীরে নতুনের প্রতিফলন করা। কবিতার ঘোরে থাকা। কবিতার জন্য ঘোর লাগা ভাব অতিপ্রয়োজন। যা অগ্রজ কবি আশরাফ জুয়েলের আছে। কবির ঠোটে ঠোট মিলিয়ে বলতে চাই, ‘যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব’ যেমন, তেমনিভাবে বলা যায়, ‘ঘোর লাগা ছাড়া ভালো কবিতাও অসম্ভব।’

লিখেছেনঃ জব্বার আল নাঈম

সর্বশেষ আপডেটঃ ৪:৩৫ অপরাহ্ণ | জুলাই ২৬, ২০১৬