পাবনায় ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র আশ্রমের সেবককে কুপিয়ে হত্যা
অনলাইন ডেস্ক | ১০ জুন ২০১৬, শুক্রবার
পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা করেছে দূর্বৃত্তরা। শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে সেবাশ্রমের ২০০ গজ দূরে পাবনা মানসিক হাসপাতালের প্রধান ফটকের কাছে এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৫ সদস্যের তদারকি কমিটি গঠন করেছে প্রশাসন।
সেবাশ্রমের সাধারণ সম্পাদক যুগল কিশোর ঘোষ জানান, নিত্যরঞ্জনের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার আড়ুয়াকংশুর গ্রামে। তার বাবার নাম রশিকলাল পাণ্ডে। তার স্ত্রী ও সন্তানরা গোপালগঞ্জে থাকেন। গত ৪০ বছর ধরে এই আশ্রমে আশ্রিত থেকে সে ধর্ম সেবা দিয়ে আসছিলেন নিত্যরঞ্জন। ডায়াবেটিস ছিল বলে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হতেন। আজও হাঁটতে বেরিয়ে খুন হয়ে গেলেন।
হত্যাকা-ের ধরন দেখে পুলিশ বলছে, নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ দেওয়া হয়। ঘাড়ে ও মাথায় এমনভাবে কোপানো হয়ে যে দেখে মনে হয় খুনিরা তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছিল।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুলৱাহ আল হাসান জানান, প্রতিদিনের মতো ভোরে রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলেন নিত্যরঞ্জন পান্ডে। পাবনা মানসিক হাসপাতালের উত্তরপাশে প্রধান গেটে পৌঁছালে দূর্বৃত্তরা পেছন থেকে নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে ঘাড়ে-মাথায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। এতে ঘটনাস’লেই মারা যান সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পান্ডে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস’ল থেকে নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে। তবে কারা কি কারণে নিত্যরঞ্জনকে হত্যা করেছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। ওসি হাসান আরও জানান, হত্যার কারণ ও হত্যাকারী সম্পর্কে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লাশ ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে।
স’ানীয় এনজিও কর্মী নরেশ মধু বলেন, উনি দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। এ এলাকারই মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। সৎসঙ্গ সেবাশ্রমে কাজ করতেন। সাদামাটা মানুষ, কোনো শত্র্ব ছিল বলে শুনিনি। বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর সামপ্রতিক হামলার মত নিত্যরঞ্জন হত্যার পেছনেও জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলে তার সন্দেহ।
এই হত্যাকার খবর পেয়ে পাবনা পুলিশ সুপার আলমগীর কবিরসহ পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা ঘটনাস’লে আসেন। কিন’ কারা এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য তারা দিতে পারেননি। তবে পুলিশ সুপার জানান, হত্যার কারণ উদঘাটনে এবং এ হত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে এর মধ্যেই পুলিশ অধিকতর তদন্তে নেমেছে। তিনি জানান, হত্যাকান্ডের তদন্তে সহায়তার জন্য ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-সহকারি পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শেখ সেলিম, সদর থানার ওসি আব্দুলৱাহ আল হাসান ও দুইজন এসআই।
দেশের বিভিন্ন স’ানে ধারাবাহিক হত্যাকা-ের অংশ হিসেবে পাবনার হেমায়েতপুর অনুকুল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জনকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এ ঘটনায় মামলা হয়নি। জড়িত কাউকে সনাক্ত কিংবা আটক করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে সরেজমিনে ঘটনাস’ল পরিদর্শন করেছেন ভারতীয় সহকারি হাই কমিশনার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়। শুক্রবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ভারতীয় সহকারি হাই কমিশনার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় হেমায়েতপুর শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সেবাশ্রমের আসেন। এ সময় তিনি সেবাশ্রমের কর্মকর্তা ও নিহত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডের শ্বাশুড়ী সহ স্বজনদের সাথে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, আমি এই ঘটনার দুঃখ প্রকাশ করতে, সমবেদনা জানাতে এখানে এসেছি। আমি কোন গণমাধ্যমে কথা বলতে আসিনি। তিনি নিহতের পরিবারকে সব ধরণের সহযোগিতা-সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেন।
এর আগে দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে ঘটনাস’ল পরিদর্শনে আসেন র্যাব-১২ সিও (ডিআইডি) শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তাৎৰণিক প্রতিক্রিয়ায় র্যাব-১২ সিও শাহাবুদ্দিন বলেন, ঘটনাটি অতীব দু:খজনক। পুলিশ, প্রশাসনের পাশাপাশি জনগণ যদি আমাদের সহায়তা করেন, তাহলে খুব শীঘ্রই আমরা এই ঘটনার সাথে জড়িতদের সনাক্ত করাসহ গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সৰম হবো। তিনি বলেন, দেশে একের পর এক হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে। পাবনার এই হত্যাকান্ডের সাথে ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডের কোন যোগসূত্র আছে কি না সেদিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই ঘটনায় আমরা প্রাথমিক স্তরে অবস’ান করছি। ইতোমধ্যে আমাদের টিম তদন্ত করতে শুর্ব করেছে। আমরা আশাবাদী খুব শীঘ্রই এই ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হবো। তবে ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত ভাবেই সংঘটিত করা হয়েছে বলে বিভিন্ন তথ্যের আলোকে এটি ধারণা করা হচ্ছে।
এ সময় পাবনার পুলিশ সুপার আলমগীর কবির, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মাকমুদা সিদ্দিকী, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সালমা খাতুন, জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহসভাপতি রেজাউল রহিম লাল, সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক যুগোল কিশোর ঘোষ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বাবু চন্দর চক্রবর্তী, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বিনয় জ্যোতি কুন্ডু, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের বাদল ঘোষ, সহ জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপসি’ত ছিলেন।
এর আগে দুপুর সাড়ে ১২ টায় পাবনা টাউন হল মুক্তমঞ্চের সামনে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ পাবনা শাখা ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ পাবনা শাখার যৌথ আয়োজনে মানববـন রচনা করা হয়। মানববন্ধন চলাকালে বক্তারা বলেন, নিত্যরঞ্জন পাণ্ডের হত্যাকারীদের অবিলম্বে সনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। একই সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস’া জোরদারের দাবি জানানো হয়। এ সময় উপসি’ত ছিলেন বাবু চন্দর চক্রবর্তী, যুগোল কিশোর ঘোষ, বিনয় জ্যোতি কুন্ড বাদল ঘোষ, প্রলয় চাকী, প্রভাষ, প্রবীর সাহা, শেফালী সিংহ, জয়দেব কুন্ড ও সোমেন সাহা বানু।
এক সপ্তাহে দুর্বৃত্তদের কোপে ও গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত ৫ জুন (রোববার) চট্টগ্রামে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ঢাকার পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু (৩৫) নিহত হন। একই দিন নাটোরে দুর্বৃত্তদের কোপে খ্রীস্টান দোকানি সুনীল গোমেজ (৬৫) নিহত হন। এরপর দুই দিন পর ৭ জুন ঝিনাইদহে আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে (৬৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। শুক্রবার পাবনায় সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে (৬২) হত্যা করা হলো।
গোপালগঞ্জের নিত্যরঞ্জন পাণ্ডের গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম
স্টার মেইল: পাবনার হেমায়েতপুরে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র সৎসঙ্গ আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার আড়ুয়াকংশুর গ্রামে চলছে শোকের মাতম। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের কান্না ও আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ বাতাস। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসী।
নিহতের গ্রামের বাড়ি আড়ুয়াকংশুরে গিয়ে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার আড়ুয়া কংশুর গ্রামের রসিক লাল পান্ডের ৭ ছেলে-মেয়ের মধ্যে ৪র্থ সন্তান নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে ৪০ বছর ধরে তিনি পাবনায় শ্রী শ্রী অনুকুল চন্দ্র সৎ সংঘ আশ্রমে ধর্ম প্রচার করে আসছিলেন। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘ বছর সেখানে তিনি থেকেছেন। এ ধর্ম প্রচারক সাথে শুধু পাবনাতেই নয় গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জেও কারো সাথে কখনো জড়ায়নি বিবাদে। অত্যান্ত সাধাসিধে লোক হিসাবে পরিচিত এই লোকটি মানুষের জন্য, র্ধরে জন্য আত্মনিয়োগ করেছেন সারাটা জীবন।
নিত্যরঞ্জন পাণ্ডের রয়েছে স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে তার চাকরির সুবাদে গোপালগঞ্জেই থাকে। ছোট মেয়ে পাবনা থেকে ডিগ্রী পাস করে এখন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে এমএতে লেখাপড়া করছে।
হঠাৎ করে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হবার খবর গ্রামের বাড়ীতে আসার পর শোকের ছায়া নেমে এসেছে পরিবারে। স্বামী, পিতা আর ভাই হারানো সংবাদে বার বার মূর্ছা যাচ্ছে স্ত্রী, সন্তান আর ভাইরা। এলাকাবাসী খবর পেয়ে নিহতের বাড়ীতে গিয়ে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্ঠা করছেন। কিন’ কোন স্বান্তনাই যেন তাদের আহাজাড়ি থামাতে পারছে না। এই ধর্মযাজক নিহত হবার পর পুরো পরিবার এখন নিমজ্জিত হল অন্ধকারে।
কি কারণে তাকে সন্ত্রাসীদের হাতে এভাবে প্রাণ দিতে হলো এমটাই প্রশ্ন পরিবার ও এলাকাবাসীর। এ হত্যাকা- একদিকে যেমন পরিবার মেনে নিতে পারছেন না অন্য দিকে এলাকাবাসীও মেনে নিতে চাইছে না।
এলাকাবাসী জানান, নিহত নিত্যরঞ্জন পা-ে ছিল একজন ভাল লোক। ধর্মকথা প্রচার করে থাকেন তিনি। এটাই কি তার অপরাধ। আমরা কোন ভাবে এ হত্যাকান্ড মেনে নিতে পারছিনা। দ্র্বত এ হত্যাকান্ডের বিচার দাবী জানায় তারা।
নিহতের বড় ভাই সত্য রঞ্জন পান্ডে, ছোট ভাই সুরঞ্জিত পান্ডে, ছোট বোন পদ্ম বল জানান, তাদের ভাই ছিলেন খুবই ভদ্র। কারো সাথে তার কোন বিবাদ ছিল না। জীবনের বেশীর ভাগ সময়েই তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে পাবনায় বসবাস করতেন। ৮/১০ দিন আগে একবার তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে রেখে তিনি একা চলে যান পাবনায় তার কর্মস’লে।
স্ত্রী দুলু রানী পন্ডে কান্না জড়িত কন্ঠে আহাজারি করতে করতে বলনে, কি কারনে আমার স্বামীকে মেরে ফেলা হল। এখন আমি ছেলে মেয়ে নিয়েকি করে থাকব। তার সাথে কারও কোন বিবাদ ছিল না। তাহলে কেন তাকে মেরে ফেলা হল। নিহতের বড় ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল শিক্ষক নন্দ দুলাল পান্ডে জানান, সারা দেশে সামপ্রতিককালে সাধু বা ধর্ম যাজকদেরকে বেছে বেছে হত্যা করা হ”েছ। তিনিও চেয়েছিলেন বাবাকে সতর্ক করতে। কিন’ তার আগেই সন্ত্রাসী হামলায় তার বাবাকে মারা যেতে হয়েছে। তিনি এ হত্যা কান্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। তিনি আরো জানান, বাবার মৃতদেহ গোপালগঞ্জ নিয়ে আসা হবে। এরপর ধর্মীয় রীতি মেনে গোপালগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে তার সৎকার করা হবে।