ইতিহাস স্বরণে সমসাময়িক বাদ্যযন্ত্রে মানব জীবনযাত্রার কাহিনী
নজরুল ইসলাম তোফা: সুজল-সুফলা শস্য শ্যামলা আবহমান বাংলার পল্লী কবি জসীম উদ্দীন এবং জীবনানন্দ দাশের বহু কবিতায় গ্রামাঞ্চলের জীবনের শাশ্বত রঙিন রূপের অবয়বকে যুক্ত করেই গভীর নান্দনিকতায় সমসাময়িক জীবন চিত্রের বিভিন্ন রূপরেখাকে সময়ের নাগর দোলায় দুুুুলিয়ে মানব আত্মায় বাদ্যযন্ত্রের ঝংকারে এক স্পন্দনের আবহ ফুটিয়েছে।
গ্রামীণ এই বৈচিত্র্যে অনিন্দ্য স্পন্দন সমসাময়িক ও অতীতের বাদ্যযন্ত্রকে নিয়ে বৃত্তাকারের মতো ঘুরে ফিরেই যেন সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন ও সর্বোপরি প্রাকৃতিক জীবনকে অনেকাংশে খুব সচল রেখেছে। বাঙালির আচার আচরণে, ঘরে ও বাইরে, গ্রামে ও গঞ্জে, মেলা-খেলায়, হাটে ও ঘাটে দৈনন্দিন জীবনচক্রে গ্রামাঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্রের চর্চা অক্ষুন্ন রেখেছে এবং তার বৈচিত্রময় আবহ আর শব্দের মুর্ছনাকে গ্রামীণ জনপদের মানুষেরা খুবই সমাদৃত করে রেখেছে।
মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যপূর্ণ ভাবেই লোকজ ধারার বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে নব্য যুগের মধ্য দিয়ে আরও সময়ের ধারাবাহিকতায় নানা রূপান্তর চক্রের পরেই আজকের এসময়ে এসে গ্রামাঞ্চলের মানুষের হাতেই লোকজ বাদ্যযন্ত্রের শোভা বর্ধন হয়েছে এবং তাকে সংস্কৃতির প্রতিটি অঙ্গনে যেন পুংখানুপুংখ ব্যবহার করে গ্রামীণ অনুষ্ঠানকে প্রানবন্ধ করছে।
আদিম মানব জাতিগণ লজ্জা নিরারণের জন্য গাছের ছাল বাকল লতা পাতা পরে ঢাক ঢোল বাজিয়ে উৎসবমুখর ভাবে নানা ঢঙ্গেই সেই সময় বিনোদন করেছিল। তার পর আস্তে আস্তেই সংযোজন বিয়োজনের এক পর্যায়ে লোকজ বাদ্যযন্ত্র গ্রামাঞ্চলের মানুষনের দোর গোড়ায় পৌঁছেছে। সুতরাং এমন জীবনাচরণে অনেক পরিবর্তন এনে আজকের লোকজ সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্র খুব শ্রুতিমধুর হয়ে উঠেছে ও তাকে নিয়েই গ্রামীণ জনপদের মানুষরা গানের সঙ্গে বাজিয়ে পুলকিত হচ্ছে। মদ্দা কথায় বলতে গেলে বলা যায়, শিকড় বা গোড়ার আদলে সৃষ্টি আজকের গ্রামীণ জমতার মিউজিক বা বাদ্যযন্ত্র সবই লোকজ বাদ্যযন্ত্র।
এমন এই বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে প্রামাঞ্চলের মানুষরা লাঠি খেলায়, কিচ্ছা কাহিনীতে, যাত্রা ও জারিগানে, বিয়ে শাদি ও নৌকা বাইচে, পুতুল নাচ ও সার্কাসের রঙ্গ মঞ্চে, বাউল গানে ও বনভোজনে বিনোদন পূর্ণ ভাবে লোকজ বাদ্যযন্ত্রের ঢং বা ধারা অব্যাহত রয়েছে। জীবনে তাদের নানা কর্মে ও বিয়ে শাদির আচার আচরণের আনুষঙ্গিতায়, যেমন, বরকনের গায়ে হলুদে গীত গাওয়া, বিয়ের পর দিরা গমনে, একেক অঞ্চলে বিয়ের একেক রীতি সেদিকেই লক্ষ্য রেখে বাদ্যকররা বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। কনের প্রথম শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় নানি দাদি বা প্রবীণ কারও সঙ্গে যাবার বিভিন্ন রেওয়াজেও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে পরিবেশকে অনেকাংশে উৎসবমূখর করে তোলে।
এই লোকজ বাদ্যযন্ত্রের বিশাল আয়োজনের দৃশ্যপট আবহমান বাংলার নববর্ষ। এমন নববর্ষে গ্রামীণ জনতার সম্প্রীতির বন্ধনে অনেক মেলা খেলার উৎসব হয়। সেখানে হরেক রকম বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে বৈশাখের আগমনকে বরণ করে। আসলে এদেশের প্রতিটি অঞ্চলে বা শহরে সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ মিলিত হয়ে এখন যে উৎসবে মেতে ওঠে তার সব টুকুই যেন লোকজ সংস্কৃতি। শিশু ও কিশোর বেলায় গ্রামের সেই যে পথ ঘাট, বট তলার করুন বাঁশির সুর, ঢাকের হৃদয় স্পর্শী বাদ্য, কবি গান, পালা গান ও গীতের সঙ্গে হেলে দুলে নাচ ভারি চমৎকার। আরোও ব্যাপকতা পেয়েছে রাষ্ট্রিয় ভাবে। সরকারি কর্মচারী এবং কর্ম কর্তাদের বৈশাখী ভাতা প্রদান করে যেন তাদেরকে শিকড়ের সন্ধানে লোকজ সংস্কৃতির প্রেমে উদ্ধোধ্য করছে। তাই তো জ্ঞানী গুনিরা গ্রাম গ্রামান্তরে আজ লোকজ সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্র খোঁজে নিয়েই শহরমুখী হচ্ছে। সুতরাং গ্রামের মানুষেরা লোকজ আদলের ঢাকঢোল, একতারা বাজিয়ে গান করে অবহেলিত অধ্যায় থেকে আধুনিক অঙ্গনে উঠা বসার সুযোগ পাচ্ছে।
আরও জানার প্রয়োজন তা হলো, গ্রামের গৃহস্থ বা কৃষানিরা তাদের বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করে মাটি ও পানির এক প্রকার মিশ্রণে কাপড়ের টুকরো অথবা কিছু খড় দিয়ে লেপে দিয়ে সেখানে ঢুলিরা ঢোলের বাদ্যে গাঁয়ের বধূরা নানান গীত গেয়ে নেচে নেচে মজা করে। আবার গ্রামীণ পুরুষরা নৌকায় মাঝ নদীতে গিয়ে চাঁদের আলোয় যেন লোকজ সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। গ্রামাঞ্চলের মানুষরা অগ্রহায়ণে ধান কাটাকেই উপজীব্য করে ফসলের মাঠে সারা রাত্রি সারিবদ্ধ ভাবে বসে বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে অঞ্চল ভেদে নিজস্ব সুরেই যেন গান করে। এ সুর ও বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আসলেই যেন লোকজ সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।
এমন এ সংস্কৃতির ধারায় শীতের কুয়াশা ভরা চাঁদের আলোয় মৃদু মৃদু বাতাসে বাড়ির আঙ্গিনায় বাউলের গানে ও বাদ্যের সুরে যেন একতার টানে ও ঢোলির ঢোলের তালের সঙ্গেই তো রয়েছে অনেক বাদ্যযন্ত্র। যেমন, ডুগডুগি, ডুগী তবলা, ঝনঝনি, ড্রাম, সাইট ড্রাম, ফুলট, কর্নাট, কংগো এবং আধুনিক যুগের যন্ত্র ক্যাসিও। এসবই আজকের লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে এক সুতায় গাঁথা। তাছাড়া জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাবগান, নৌকা বাইচের গান, মুর্শিদীগান, আলকাপ গানেও এমন লোকজ সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয় ঘটিয়ে গ্রামের মানুষরা উৎসবে বাজিয়ে গর্ববোধ করে। আবার এ লোকজ সংস্কৃতির বাদ্য থেকে আলকাপ গানে তারা নিয়ে যায় আঞ্চলিক গম্ভীরা গানে, তাছাড়াও যোগী গান, মনসার গান, লীলা, রামায়নী, পালা গান এবং পট গানে আদিমতম বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে নাচ এবং সঙ্গীতকে শৈল্পিক বলয় তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণের ও ধর্মালম্বীদের জীবন বৃত্তে কোন না কোন ভাবে লোকজ সংস্কৃতির এমন বাদ্যযন্ত্রের শাখা প্রশাখা খোঁজে পাওয়া যায় একেবারে এশিল্পের শিকড়ের গভীরতা থেকে।
গ্রামের কিষান কিষানিরা জীবনোপায়কে এ বাদ্যের সুরে সুরে জীবনাচারের অনেক ভালবাসাকে তুলে ধরে সারারাত্রি। আবার কলা গাছের তোরণকে লক্ষ্য করে খরার সময় বৃষ্টি যেন হয়, এ আশায় তারা বৃষ্টিতে ব্যাঙের বিয়ে দিতে পারবে এমন ভাবনায় চরম আনন্দে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উৎসব করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যেন পুরনো বট পাকুড় গাছের বিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্রবৃন্দ করেই তাদের অনেক বস্তুনিষ্ঠ ধর্মের পরিপূর্ণতায় লোকজ ধারার বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তারা খুব আনন্দ উল্লাসেই মত্ত থাকে।
বাঙালীর হাজার বছরের এমন শিল্পধারায় তৈরি হয়েছে লোকজের নিজস্ব কাব্য ও নিজস্ব সাহিত্য। যে সাহিত্যতে রস সুধায় গ্রামাঞ্চলের মানুষরা আজ মহিমান্বিত ও সমাদৃত। গ্রামীণ জনপদের মানুষের মাঝে খোঁজে পাওয়া যায় লোকজ ধারার নানান গল্প কাহিনী, গীতি কাব্য, আঞ্চলিক গীত, লোক সঙ্গীত, গীতি নাট্য, লোক নাট্য, নৃত্য নাট্যের মতো হাজারও লোকজ সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতিতে লোকজ বাদ্য না হলে যেন চলেই না। আসলে বলা দরকার, শঙ্খধ্বনিও নাকি লোকজ সংস্কৃতির একটি সূচনা বাদ্যযন্ত্র। এমন প্রাচীন লোকজ বাদ্যে শঙ্খধ্বনির অলঙ্কার যুগ যুগ ধরে লোকজ সংস্কৃতিতে এদেশের ও ভারতবর্ষের গ্রামাঞ্চলে গভীরভাবে বিরাজমান। যার প্রমাণ প্রাচীন গ্রন্থ, শিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রশিল্পীর শৈল্পীক চিত্রে উঠে এসেছে। ঝিনুকের তৈরীকৃত এ শঙ্খের ছিদ্র পথে মুখ দিয়ে ফুঁ দিলে মিষ্টি মধুর শব্দ বাহির হয়। আবার গ্রামাঞ্চলের শঙ্খের সঙ্গে নিবিড় সক্ষতা রেখেই তারা ঢাক ঢোলের চর্মাচ্ছাদিত বাদ্যযন্ত্রে আনদ্ধ হন। টাকডুম টাকডুম আওয়াজ শুনলেই তো বুঝা যায় লোকজ সংস্কৃতির আবহ ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।
বাংলা ঢোল নামে আরেক বাদ্যযন্ত্র আছে যার শব্দ সাধারণ ঢোলের চেয়ে গম্ভীর। এছাড়াও ঢোলের চেয়ে ছোট আরেকটি বাদ্যযন্ত্র আছে, যার নাম ঢোলক। ঢোলক বেশির ভাগ ব্যবহৃত হয় নাটক, যাত্রায়, গজল ও কাওয়ালী গানে ঢোলক অনেক অপরিহার্য বাদ্যযন্ত্র। আবার ঢোল একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও ঢোলের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঢোল বাদ্যে লাঠি খেলা, হোলি খেলা, নৌকা বাইচ, কুস্তি, কবি গানের আসর, জারি ও সারি গান, টপ্পা গান, বাউল গান, আলকাপ ও গম্ভীরা গান, যাত্রা গান, গাজনের গান, মহররমের শোভা যাত্রা, ছোকরা নাচ এবং বিয়ের বরযাত্রাতে বাজিয়ে গ্রামীণ মানুষ লোকজ সংস্কৃতির চর্চাকে পরিপক্ব করে তোলে। হিন্দুদের বিভিন্ন পূ্জাতে ঢোল না হলে যেন চলেই না। হিন্দু, মুসলমান, এবং আদিবাসী নির্বিশেষে করে তাদের বিভিন্ন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ঢোল ব্যবহার করে। বেশ কিছু বছর আগে সরকারি কোনও আদেশ বা পরোয়ানায় গ্রামাঞ্চলের হাটে বাজাবে ঢোল কিংবা ঢেড়া পিটিয়ে বিভিন্ন নির্দেশ মুলক কথা ঘোষণা দিয়েছে। এখন আর এমন ভাবে লোক সংস্কৃতির ব্যবহার হয়না।
বাঙ্গালীর বিয়ের অনুষ্ঠানের কথায় যদি আসি তাহলে বলা যায় শানাই ছাড়া যেন বিয়ের কথা ভাবাই যায় না। গ্রামীণ লোকজ বাদ্যযন্ত্রের আলোচনা আসলেই স্বল্প পরিসরে শেষ হবার নয়, তবুও গ্রাম্য জনজীবনের একাকিত্ব ও অবসন্ন মনের অলস দুপুরে এক বাঁশিওয়ালার বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার মধ্যে খোঁজে পাওয়া গেল সেই লোকজ বাদ্যের সুর: ‘পূবাল হাওয়া যায়রে বইয়া ঝিরি ঝিরি ঝির….
উড়াল দিছে সল্লী পংখী ধরলা নদীর তীর।
প্রাণ মোর উড়য়্যা যায়রে…
ঝাউ নাচে, কাউন নাচে, আর নাচে বন
তারে সাথে নাচিয়া ফেরে উদাস করা মন।
প্রাণ মোর উড়য়্যা যায়রে’….
নজরুল ইসলাম তোফা,
টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী,
কলামিষ্ট এবং প্রভাষক’।