| সকাল ১০:৪৪ - বুধবার - ২৪শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১৪ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

বাবা, আমি ক্যাডার হয়েছি!

আজ অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। ফজর নামাজ শেষে পড়তে বসেছি। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। এখন ৯ টা বাঁজে। ফোনটা বেজে উঠল। মা ফোন করেছেন। অলসভঙ্গিতে ফোনটা রিসিভ করলাম। বললাম, ‘মা, কেমন আছে?’ ওদিকে মার কান্নাভরা কণ্ঠ শুনতেই আমি চেয়ার থেকে সটান দাড়িয়ে গেলাম…

কবিয়াল নূর
সম্পাদক, জবস্টাডি

 

 

০১
– মা, কি হয়েছে?
– তোর বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে।
– কখন?
– আধা ঘন্টা আগে।
– এখন কোথায়?
– সদর হাসপাতালে।
– মা তোমার সাথে আর কে আছে?
– তোর নাদের কাকা। ডাক্তার বলছে রোগীর অবস্থা ভালো না, ঢাকায় ট্রান্সফার করতে হবে।তোকে ঢাকা থেকে আসতে হবে না। আমরা অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি….

 

কথাগুলো শেষ না হতেই মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আমি স্তব্দ, কথা বলার মত কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। বাবা বাঁচবে তো? ভাবনাটা মাথায় আসতেই ভিতরটা ভয়ংকর এক মোচড় দিয়ে উঠলো । চিরশুষ্ক চোখ দুটিতে অঝোর ধারার বৃষ্টি নেমে আসলো।

 

তখন ২০০৫ সাল। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করার জন্য প্রথম ঢাকায় আসি। ফার্মগেটের নামিদামি একটি কোচিং-এ ভর্তি হই। বাবা অবশ্য বলেছিল তোর এইচএসসি রেজাল্ট যেহেতু ভালো না তাই ঢাকায় যাওয়ার দরকার নেই।ময়মনসিংহেই কোন কোচিং-এ ভর্তি হ। আমি জানতাম আমার রেজাল্ট ভালো না, তবু জেদ ধরলাম। কারণ বন্ধুরা সবাই ঢাকায় কোচিং করবে তাই আমারও ঢাকায় কোচিং করা চাই। বাবা আমার জেদের কাছে হার মানলেন।আমি ঢাকায় ভর্তি হলাম। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলাম। চান্স হল না। পুরোই হতাশ হলাম। শেষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম সরকারী তিতুমীর কলেজে।

 

মেসে উঠলাম। এক রুমে দুজন থাকি। আমার রুমমেট সোহেল ভাই। বেশ ভদ্র ছেলে। ওনি কারো সাত পাঁচে নেই।কাজ বলতে তার টিউশনি আর পড়াশোনা । টেবিল ভর্তি বই সাজানো। শুধু যে পাঠ্য বই এমন না গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধসহ হরেক রকমের বই। ওনার বইয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ।টিউশনির টাকা হাতে পেলেই বই কিনে রুমে ফিরতেন। রুমে ঢুকেই বলতেন- মতিন ভাই আজ একটা দারুণ বই কিনেছি।দেখেনতো কেমন হলো?’ আমি বলতাম- এটা কি কাপড়-চোপড় নাকি ভাই, কভার দেখেই বলে দিবো কেমন হলো। ওনি হেসে জবাব দিতেন- না তাতো সম্ভব নয়, এক কাজ করেন আপনি পড়ে তারপর জানাবেন কেমন হলো।’

 

আমি বলতাম- ‘না ভাই ওসব বই টই পড়া আমার দ্বারা হবে না। আপনিই বরং পড়ে আমাকে জানায়েন।’ সোহেল ভাই হেসে জবাব দিতেন- ওকে ভাই আমি পড়ে আপনাকে পুরো সারাংশ শুনাবো। আমি ‘হু’ বলে সায় দিতাম। ওনি ঠিকই বইটি পড়া শেষে আমাকে সারাংশ শুনাতে চাইতেন।’ আমি শুনতাম, মাঝে মাঝে শুনার ভান করতাম।

 

মাঝে মাঝে বিরক্তও হতাম।ওনার একটা অভ্যাস ছিল, দৈনিক পত্রিকা আসতেই এমনভাবে ওনি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তে থাকতেন, যেন আগামীকালের ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পত্রিকা নিয়ে মাঝে মাঝেই ওনার সাথে আমার কথা কাটাকাটি হতো।ওনি সবসময় সম্পাদকীয় পাতাটি বলপেনে দাগিয়ে দাগিয়ে পড়তেন।পত্রিকা দাগানোটা আমার পছন্দের ছিলো না, তাই আমি নিষেধ করতাম। বলতাম- ভাই পত্রিকায় দাগাবেন না। তারপরও তিনি দাগাতেন। মাঝে মাঝে পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাটিই হাওয়া হয়ে যেত। একদিন শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ছিলাম।সোহেল ভাই টিউশনি থেকে রুমে ফিরেই বললেন,

 

-মতিন ভাই, সম্পাদকীয় পাতাটি দেনতো, প্লিজ?’
-একটু পরে পড়েন, আমি শেষ করি।
-আপনিতো সম্পাদকীয় পাতা পড়েন না।
-আমি কোনটা পড়ি কোনটা পড়িনা তার হিসেব আপনার রাখার দরকার নেই।

 

রাগকে কন্ট্রোল করে সোহেল ভাইকে সম্পাদকীয় পাতাটি দিলাম।আমার কথায় তাঁর কিন্তু কোন রাগ নেই! হাসি মুখে বললেন- থ্যাঙ্কু ভাই।
সম্পাদকীয় পাতাটি নিয়েই তিনি বলপেন দিয়ে দাগিয়ে পড়ছিলেন।পূর্বেও বহুবার তাকে দাগাতে নিষেধ করেছি কিন্তু তাঁর চেতনার কোন পরিবর্তন নেই। আমি রাগত্ব স্বরেই বললাম, নিষেধ করার পরেও আপনি সম্পাদকীয় পাতা দাগান কেন?

 

– ভাই কেউ সম্পাদকীয় পেজটি পড়ে না, তাই আমি দাগিয়ে পড়ি।আপনারা কেউ পড়লে দাগাতাম না।যেমন ধরুন, আন্তর্জাতিক, খেলাধুলা ইত্যাদি পাতাগুলো সবাই পড়ে বিধায় সেগুলো কিন্তু আমি দাগাই না।

-কেউ পড়ুক আর না পড়ুক আপনি দাগাবেন না।

 

সেদিন থেকে সোহেল ভাই পত্রিকায় দাগ টানতেন না। পড়ে পড়ে নোট নিতেন। এরকম ছোট খাট অনেক বিষয়ে সোহেল ভাইয়ের আমার সাথে ঝগড়া হতো।

 

সত্য বলতে পড়াশোনা আমাকে কখনই টানতো না। বন্ধুবান্ধবের অভাব ছিলনা। বাড়ি থেকে টাকা আনতাম, দুহাতে খরচ করতাম। মাঝে মাঝে মা বলতেন, ‘তোর বাবার ব্যবসাটা খুব ভালো যাচ্ছে না। খরচ টরচ একটু কম করিস। সম্ভব হলে পার্টটাইম কিছু একটা কর।’

আমি বলতাম, মা, পড়াশোনার চাপ অনেক, এখন কোন কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

মা বলতেন, পড়াশোনার ক্ষতি হলে কিছু করার দরকার নেই। এতদিন কষ্ট যেহেতু করতে পারছি, বাকী কটা দিনও পারবো।

বাবার ছোট্ট একটা মুদির দোকান ছিল। সেই দোকানের আয়ে আমাদের সংসার চলত। সাথে আমার পড়াশোনা এবং ছোট ভাই বোনদের পড়াশোনা। জানতাম এত অল্প আয়ে সংসার চালানো বাবার পক্ষে খুব কঠিন ছিল। কিন্তু এসব আমার মনে কোন দাগ কাটতো না। জীবনে কত যে মিথ্যে বলে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, তার হিসেব নেই।এখন মিথ্যে বলতে তাই কোন অপরাধবোধ কাজ করেনা। আমার কাছে বন্ধু-বান্ধবের সাথে মজা-মাস্তিই ছিল আসল স্বপ্নের জগৎ। সেই স্বপ্নের জগতে কখনও শিল্পী হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছি, আবার কখনওবা অভিনেতা। প্রতিদিন রঙ্গিন স্বপ্নেরা এতটাই আমাকে আছন্ন করে রাখত যে, মনে হোত উচ্ছৃঙ্খল জীবনটাই বাস্তব। এটিই আমার ক্যারিয়ার।

 

০২
আমি গিটার বাজাচ্ছি।সোহেল ভাই পড়ছেন।ওনি সবসময় নি:শব্দে পড়েন। আজ আমার গিটার বাজানোর শব্দের বিপরীতে ওনি শব্দ করে পড়ছেন। ইদানিং বেচারার প্রতি আমার রাগ ক্ষোভ বেড়েই চলছে ।সকাল, বিকাল, রাত সবসময় শুধু পড়াশোনা! রুমে বিনোদন, আড্ডার কোন সুযোগ নেই।রুমের পরিবেশটা পুরো কাঠখোট্টা করে ফেলেছেন।মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘সোহেল ভাই দিনরাত পড়াশোনা করে কি লাভ? চাকরি বাকরি হচ্ছে না। শুধু শুধু পণ্ডশ্রম।’ বেচারার মাস্টার্স শেষ, এখনো চাকুরি কপালে জুটেনি। শুধু গাদার খাটুনি খেটে চলছেন। কবে চাকুরি হবে তা আল্লাই মালুম। একদিন সোহেল ভাইকে বললাম, ‘ভাই এই যে এতো পড়াশোনা করছেন, তাতে কি লাভ হচ্ছে বলুনতো?’ আমার কথা শুনে মানিক ভাই হেসে বললেন, ‘হবে ভাই হবে।

 

এতে অধৈর্য্ হওয়ার কি আছে! আমি অনার্স সম্পূর্ণটাই সাবজেক্টিভ পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলাম, চাকুরি পড়াশোনা করার সুযোগ পাইনি। অনার্স শেষে চাকুরি পড়াশোনা শুরু করেছিলাম, কিন্তু কদিন না যেতেই মাস্টার্সের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যাক মাশাল্লাহ অনার্স মাস্টার্স দুটো রেজাল্ট-ই কিন্তু ভালো হয়েছে। এখন পুরোদমে চাকুরি পড়াশোনা শুরু করেছি, প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে চাকুরি পাবো নিশ্চিত।

 

সম্পূর্ণ প্রিপারেশন ছাড়া চাকুরি পাওয়াতো সম্ভব নয়।’ মানিক ভাইয়ের কথায় সবসময় দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস থাকত। কিন্তু আমার ওসব শুনে মন ভরত না। ইদানিং মানিক ভাইয়ের পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়ায় ৪টি টিউশনির ২টাই ছেড়ে দিয়েছে, এজন্য দিনের বড় একটা সময় এখন রুমেই কাটান।যার ফলে রুমে আড্ডা, বিনোদন কোনটারই করার সুযোগ পাইনা। সে রুমে থাকলে রুমের নিয়মনীতিও বেশ কড়াকড়ি।মাঝে মাঝে মনে হয় দম বন্ধ হয়ে আসছে। সিগারেট খাওয়া যাবেনা, অথচ সিগারেট ছাড়া আমি এক মূহুর্তেও থাকতে পারি না। বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দেওয়া যাবে না, অথচ বন্ধু ছাড়া লাইফ ইমপসিবল। সশব্দে গান বাজানো যাবে না, অথচ বিনোদন ছাড়া জীবন শুষ্ক মরুভূমি। না, এসব আর ভালো লাগে না। এর একটা বিহীত করতেই হবে। আমার কাছে সমস্যার সমাধান মনে হচ্ছে বেচারাকে রুম থেকে বের করে দেয়া।

 

কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তাহলে কি করা যায়? হুম পেয়ে গেছি। আমার জীবন আমার, আমার জীবন আমি স্বাধীনভাবে চালাবো।ব্যস্, এটুকুই। তাই আজ থেকে রুমেই গিটার বাজানোর প্র্যাকটিস শুরু করেছি।বেচারার অবস্থা কাহিল দেখে বেশ মজাই পাচ্ছিলাম । এক লাইন ৫ বার করে পড়ছে।মনে হচ্ছে রাগে ফেটে যাচ্ছে।

 

আমিও কোন অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ সোহেল ভাই অসহায়ত্বের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মতিন ভাই ছাদে গিয়ে গিটারটা বাজান, আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে।’ আমি ওদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। সোহেল ভাইকে ক্ষীণ কণ্ঠে বলতে শুনলাম, ‘যে বিনোদন অন্যের ক্ষতির কারণ হয়, তা বাজানোর যৌক্তিকতা কি? এটা কি কোন মৌলিক অধিকারের ভিতর পড়ে?’

 

০৩
এলার্ম ঘড়িটি বেজেই চলছে।সকাল সকাল এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় মেজাজটা বিগড়ে গেল। শালার এলার্ম ঘড়ি বাজার সময় পেলি না! সোহেল ভাই ভোরে উঠার জন্য ইদানিং এলার্ম দিয়ে রাখেন। কি অসহ্য যন্ত্রণা! এত ভোরে এলার্ম দিয়ে ঘুম নষ্ট করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? না আর সহ্য করা যায় না। তাই ঘুম থেকেই ঝাঝালো কণ্ঠে বললাম, ‘ভাই, এলার্ম বন্ধ করেন। এরপর থেকে আর এলার্ম দিয়ে রাখবেন না।’ আমার ঝাঝালো কণ্ঠ শুনে সোহেল ভাই তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে বসলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই রাগ কইরেন না। আমাকে ভোরে উঠতে হয়, তাই সতকর্তার জন্য এলার্ম ঘড়িটা ব্যবহার করি।তাছাড়া সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা ভালো। আমি প্রতিদিনের ভোর দেখতে চাই। একটি চমৎকার দিন শুরু করতে চাই।’ আমি কিছু বললাম না, আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। সকাল ৯ টায় তখনও ‍ঘুমে। মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল।

 

-মতিন, তুই কই?
-কেন, মেছে।
-কলেজে আসবি না?
-না।সজিব, রাকিবদের নিয়ে আমার মেছে চলে আয়, মুড়ি পার্টি হবে।
-তাই্ নাকি! ওক্কে বেবি, আমরা আসছি।

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ৫ জন বন্ধুবান্ধব এসে হাজির। আমি অবশ্য ইচ্ছা করেই তাদেরকে মেছে ডেকেছি। উদ্দেশ্য সোহেল ভাইকে একটা চরম শিক্ষা দেয়া। সোহেল ভাই আমার ২ বছর সিনিয়র হলেও একে অপরকে আমরা আপনি বলেই সম্বোধন করি। সিগারেট টানা আমার নেশা।আমি সিগারেট টানলেও মেছে উঠার সময় একটা কন্ডিশন ছিল রুমে কোন ধরণের বিড়ি, সিগারেট খাওয়া যাবে না।তাই আমি কখনও সোহেল ভাইয়ের সামনাসামনি সিগারেট টানি নি। দীর্ঘদিনের এই সংবিধান ভঙ্গ করে আজ সোহেল ভাইয়ের সামনেই সিগারেট ধরালাম। সাথে বন্ধুদের নিয়ে মুড়ি পার্টির আয়োজন। সময়টা চমৎকার উপভোগ করছিলাম। ওদিকে সোহেল ভাই রাগে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছিলেন।

 

সেদিনের টেকনিক খুব কাজে দিয়েছিল। মুড়ির পার্টির পর থেকে সোহেল ভাইকে আর রুমে পাওয়া যেত না। আমি সকাল ১০টায় ঘুম থেকে উঠতাম আর উনি ৯ টার মাঝেই রুম থেকে বের হয়ে যেতেন। কোথায় যেতেন, কি করতেন কিছুই জানতাম না।

 

০৪
১০ মাস পরের গল্প । আমি অনার্স, মাস্টার্স শেষ করলাম। বিভিন্ন জায়গায় জব এপ্লাই করছি, পরীক্ষা দিচ্ছি কিন্তু একটি প্রিলিমিনারি/এমসিকিউ পরীক্ষাও উত্তীর্ণ হচ্ছিলাম না। দিন দিন মন ভেঙ্গে যাচ্ছিল। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকেই বাবা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। পড়ে গেলাম অথৈই সাগরে।কোন কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছিল না। দিন দিন সময়টা দু:সহ হয়ে উঠছিল। সিগারেটের খরচও বেড়ে যাচ্ছিল। একদিন বাবা রাগ করে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। মা ফোনে সবসময় বলতেন, ‘বাবা, একটা কিছু কর। এখনতো আর পারছি না।

 

তোর বাবার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।তোর দিকেই পুরো পরিবার তাকিয়ে।’ মার কথা শুনে প্রায় রাগ হত।মনে মনে বলতাম, ‘চাকরি কি মামার বাড়ির আবদার, চাইলেই পাওয়া যাবে।’ মাঝে মাঝে মার সাথে রাগ করে বলেই ফেলতাম, ‘ আমি কি চেষ্টা করছি না, আমি কি বসে বসে আঙ্গুল চুষছি।’ জানতাম আমার কথা শুনে মা কষ্ট পেতেন, কিন্তু প্রকাশ করতেন না, আমাকে উল্টো শান্ত্বনা দিতেন। এতদিনে সোহেল ভাইয়ের গল্প অনেকটাই বদলে গেছে। ইতিমধ্যে তিনি ৩৩তম বিসিএস এর ভাইভা দিয়েছেন, ৩/৪টি নন-ক্যাডার জব ও ব্যাংকের ভাইভাও দিয়েছেন। বলে রাখা ভালো, সোহেল ভাইয়ের সকাল ৯ থেকে রাত ৯ টায় বাহিরে থাকার রহস্য উদঘাটন হয়েছে।রহস্যটি ছিল এরকম-সকাল ৯ থেকে রাত ৯ টা পর্য্ন্ত ২টি টিউশনি ব্যতিত বাকী সম্পূর্ণ সময় সোহেল ভাই লাইব্রেরিতেই কাঁটাতেন।চাকুরি পড়াশোনা করতেন।দিন দিন যত বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি, ততই সোহেল ভায়ের নিকট লজ্জার পাল্টাটি ভারি হচ্ছে।সত্য বলতে চরম বাস্তবতা

 

এখন আমাকে আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়েছে। এই সময়ে এসে সোহেল ভাইয়ের দৃঢ়তা ও অধ্যায়বসায়ের কাছে আমি লজ্জিত।আমি সোহেল ভাইয়ের কাছে আমার কর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছি। একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, ‘ভাই, আমি আপনার সাথে যে আচরণ করেছি, তার জন্য আমি লজ্জিত।প্লিজ ছোট ভাই হিসেবে ক্ষমা করেন।’

 

সোহেল ভাই হেসে বললেন, ‘আরে এখানে ক্ষমা চাওয়ার কি আছে? তোমার আচরণে আমি কষ্ট যদিও কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু মনে রাখিনি।আমি জাস্ট সমস্যাটার সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। কারণ আমি আমার সফলতার জন্য কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতাকে অজুহাত হিসেবে দাড় করাতে চায়নি। আমি নিজেকে বুঝাতে চায়নি ‘পরিবেশ আমার অনুকূলে ছিল না, তাই সফল হতে পারি নি। বরং আমি চেয়েছি, পরিবেশ আমার যত প্রতিকূলেই থাক না কেন আমি সফল হবই। যদিও এখনও আমি সফল নই, তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

 

০৫
গত পরশুদিনের ঘটনা।দুপুর ২ টা বাজে তখন। সোহেল ভাই চরম অস্থিরতা নিয়ে রুমের মাঝেই পায়চারি করছিলেন। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, সম্ভবত কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি নিজেও ভয় পেয়ে গেলাম। সোহেল ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই কোন সমস্যা?’ তিনি মাথা ঝাকিয়ে জবাব দিলেন ‘না’। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে আপনি এতো অস্থির কেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আজ ৩৩তম বিসিএস-এর রেজাল্ট দিবে।’ আমি বললাম, ‘ভাইআজ রেজাল্ট দিবে আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম।টেনশন কইরেন না, সুখবরই আসবেই।’ সোহেল ভাই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন আর আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠছিলেন।

 

তিনি ফেসবুকের গ্রুপে বারবার ঢু মারছিলেন কোন আপডেট আছে কিনা? হঠাৎ একজন গ্রুপে পোস্ট করলেন, ‘৩৩তম বিসিএস-এর রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে। যারা ৩৩তম বিসিএ-এ উত্তীর্ণ হয়েছেন, সবাইকে অভিনন্দন।’ সোহেল ভাই চরম উত্তেজনার মাঝে বিপিএসসির ওয়েবসাইট সার্চ করলেন, দেখলেন সত্যি রেজাল্ট দিয়েছে। তিনি কাপা হাতে তার রোল নম্বরটি সার্চ দিলেন।সার্চে নম্বরটি ম্যাচিং করতেই লাফিয়ে চিৎকার দিলেন, ‘মতিন ভাই আছে আছে…’। কিন্তু পরক্ষণেই আবার স্তব্দ হয়ে গেলেন, ‘সত্যি এটি কী আমার রোল নাম্বার!’ তিনি এবার সার্চ না দিয়ে একটা একটা করে খুঁজে দেখতে লাগলেন।

 

এবারও রোল পেয়ে গেলেন। ফিস ফিস করে বললেন, ‘মতিন ভাই, অ্যাডমিন ক্যাডার ৫ম তম!’ তিনি আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘জানেন মতিন ভাই, বাবাকে আর রিক্সা চালাতে হবে না!’ এবার আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফোনটি হাতে নিয়ে সোহেল ভাই তার বাবাকে ফোন দিলেন। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করে সোহেল ভাইয়ের বাবা বললেন, ‘বাবা সোহেল, তুমি টিউশনির টাকাটা পেয়েছ? তোমার মার ঔষধ শেষ হয়ে গেছে।আমিও তো দুদিন যাবৎ রিক্সা চালাতে পারিনি।’ দেখলাম সোহেল ভাইয়ের দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললেন, ‘বাবা, তোমাকে আর ঔষধ কেনা নিয়ে ভাবতে হবে না।

 

আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি।অ্যাডমিন ক্যাডার।’ সোহেল ভাইয়ের রিক্সা চালক বাবা কোন কথা বলতে পারলেন না। এক পাহাড় বিস্ময় নিয়ে শুধু বললেন, ‘হাছা বাজান।’ ফোন রাখতে রাখতে সোহেল ভাই স্পষ্ট ওপাশের কণ্ঠ শুনতে পেলেন, ‘ওগো সোহেলের মা জানো, পুলা ম্যাজিট্রেট হয়েছে।’

 

০৬
এমাসের শুরুতেই সোহেল ভাই মেস ছেড়ে দিয়েছেন। রুমে নতুন একজন রুমমেট উঠেছে। সোহেল ভাই যেদিন চলে যান, সেদিন আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিলেন। শুধু বলেছিলেন, ‘মতিন ভাই, কখনও আশা হারাবেন না, স্বপ্নকে কখনও ফিকে হতে দিবেন না।মনে রাখবেন, সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও অধ্যবসায় থাকলে জয় আসবেই ইনশাল্লাহ।
সোহলে ভাই চলে গেলেন। আমি আমাকে নতুনভাবে গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছি।সামনে নতুন স্বপ্ন! নতুন সংগ্রাম!আমি জানি, সময়ের এক ফোড়,অসময়ের দশ ফোড়।তবুও আমি নতুনভাবে বাঁচতে চাই।

 

চরম আর্থিক সংকটের মাঝে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি।নিজেকে নতুনভাবে গড়ার সুযোগ ‘সময়’ কি পূণরায় আমাকে দিবে? এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।তবে এটা জানি, আমি আমার স্বপ্নকে কখনই ফিকে হতে দিবো না, যত কষ্টই আসুক না কেন।

 

আজ অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। ফজর নামাজ শেষে পড়তে বসেছি। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। এখন ৯ টা বাঁজে। ফোনটা বেজে উঠল। মা ফোন করেছেন। অলসভঙ্গিতে ফোনটা রিসিভ করলাম। বললাম, ‘মা, কেমন আছে?’ ওদিকে মার কান্নাভরা কণ্ঠ শুনতেই আমি চেয়ার থেকে সটান দাড়িয়ে গেলাম।
বললাম- মা কি হয়েছে?

– তোর বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছে।

 

লেখক
কবিয়াল নূর
সম্পাদক
জব স্টাডি টুয়েন্টিফোর.কম

 

**লেখাটি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের জীবনের উপর বাস্তবিক কল্পিত কাহিনী। যার সাথে লেখকের জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। অনুপ্রেরনা যোগাতে বাস্তব জীবন নিভর করে গল্পটি লিখা। যদি লেখাটির সাথে কারো জীবনের কাহিনী মিলে যায় তাহলে লেখক বা দৈনিক লোক লোকান্তর দায়ভার বহন করবে না।

সর্বশেষ আপডেটঃ ২:২৯ পূর্বাহ্ণ | অক্টোবর ২৮, ২০১৭