ঝিনাইগাতীতে নিখোঁজের ৬ দিনেও সন্ধান মেলেনি ৩ গারো আদিবাসীর: উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় পরিবার
ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড় থেকে ফিরে মুগনিউর রহমান মনি, শেরপুর, ১৯ এপ্রিল ২০১৬, মঙ্গলবার
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড় থেকে নিখোঁজের ছয় দিন পরও সন্ধান মেলেনি তিন গারো আদিবাসীর। এঁরা হলেন ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনী গ্রামের মৃত রহেন্দ্র সাংমার ছেলে প্রভাত মারাক (৬০), সুখীন্দ্র মারাকের ছেলে বিভাস সাংমা (২৫) এবং সুমিত সাংমার ছেলে রাজেস মারাক (২২)। গত ছয় দিনেও তাঁদের সন্ধান না পাওয়ায় পরিবারগুলোয় উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ও আতংক বিরাজ করছে। পরিবারের দাবি, র্যাব সদস্যরা তাঁদের ধরে নিয়ে গেছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ বিভাসের মা বিরলা সাংমা গত ১৬ এপ্রিল শনিবার ঝিনাইগাতী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
গত ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলার গজনী গ্রাম থেকে প্রভাত মারাক ও বিভাস সাংমাকে এবং ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকা থেকে রাজেস মারাককে আইনশৃঙৰলা রৰা বাহিনীর পরিচয়ে একদল লোক ধরে নিয়ে যান। নিখোঁজদের মধ্যে বিভাস ঝিনাইগাতীর তিনআনী আদর্শ ডিগ্রী কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করেন। প্রভাত দিনমজুরের কাজ করেন। আর রাজেস ময়মনসিংহের ভালুকায় তাঁর বোনের বাসায় থেকে স্নাতক শ্রেণিতে পড়াশুনা করছেন।
আজ ১৯ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইগাতীর গারো পাহাড়ের গজনী গ্রামে গিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ভোরে কালো ও সাদা পোশাকধারী ১০-১২ জন লোক গজনী গ্রামের বাড়ি থেকে বিভাস সাংমা ও প্রভাত মারাককে ধরে নিয়ে যান। এ সময় বিভাসকে নির্যাতন ও বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রায় একই সময় আইন শৃঙৰলা রৰা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ময়মনসিংহের ভালুকা কলেজ সংলগ্ন বড় বোনের বাসা থেকে রাজেস মারাককে ধরে নেওয়া হয়।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজ বিভাসের মা বিরলা সাংমা (৬০) একমাত্র ছেলের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, বন্যহাতির হাত থেকে ফসল রৰার জন্য রাত জেগে পাহারাশেষে ভোর চারটার দিকে বিভাস বিছানায় ঘুমাতে যায়। এর কিছুৰণ পরই কালো ও সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক বাড়িতে এসে বিভাসকে ডাক দেন। এ সময় তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা নিজেদের আইন শৃঙৰলা রৰাকারী বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেন। ওই লোকগুলো বলেন, ‘আমরা তাকে নিয়ে গেলাম পরে দিয়ে যাব, চিন্তার কোন কারণ নেই’। এ সময় বাড়িতে থাকা দুটি মোবাইল ফোনও নিয়ে যান ওই লোকগুলো। বিধবা বিরলা অবিলম্বে তাঁর একমাত্র সন্তানকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানান।
বিভাসের খালাত বোন স্বপ্না হাগিদক (২৮) বলেন, কালো পোশাকধারী লোকগুলোর জামায় ইংরেজীতে ‘আরএবি’ বা র্যাব লিখা ছিল। ধরে নেওয়ার সময় বিভাসকে অনেক নির্যাতন করা হয়। আমরা ধারণা করছি, র্যাব সদস্যরা তাকে (বিভাস) ধরে নিয়ে গেছেন। কী কারণে বিভাসকে ধরে নিয়ে গেছে সে বিষয়টি বুঝতে পারছি না।
অপরদিকে নিখোঁজ প্রভাত মারাকের একমাত্র মেয়ে প্রমিতা সাংমা (২৫) বলেন, ‘বাবাকে যেদিন ধরে নিয়ে যায় সেদিন আমরা সবাই ঢাকায় ছিলাম। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে জানতে পারি কালো পোশাকধারী কয়েকজন লোক বাবাকে ধরে নিয়ে গেছেন। সংবাদ পেয়ে আমরা ঢাকা থেকে চলে আসি। এখন আমরা দুঃশ্চিন্তায় আছি আমাদের বাবাকে কীভাবে ফিরে পাব? বাবার চিন্তায় মা মদিনা সাংমা অসুস’ হয়ে পড়েছেন।’
সরেজমিনে নিখোঁজ রাজেসের গজনী গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির দুটি ঘরই তালাবদ্ধ ছিল। এ সময় প্রতিবেশী লতিফ মারাক বলেন, রাজেসের সন্ধানে সবাই ময়মনসিংহের ভালুকায় চলে গেছেন।
গজনী গ্রামে অবসি’ত গজনী ব্যাপ্টিস্টমন্ডলী উপসনালয়ের সেবিকা সুচিত্রা সাংমা (৪৮) বলেন, ‘এই তিনজনের ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আমরা এখন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আমরা চাই এদের দ্র্বত উদ্ধার করা হোক। আমরা আমাদের সন্তানদের আমাদের কাছে ফিরে পেতে চাই। আমরা সরকারের কাছে আমাদের নিরাপত্তা চাই।’
গজনী গ্রামের মুদি দোকানদার মো. মোতালেব বলেন, এখান থেকে দুই আদিবাসী গারোকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে ভুগছেন। কী কারণে তাঁদের ধরে নেওয়া হলো এলাকাবাসী তা বুঝতে বা জানতে পারছেন না।
জানতে চাইলে ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ ব্যাপারে জিডি হয়েছে। তদন্ত চলছে। তবে নিখোঁজদের ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ঝিনাইগাতীর নকশী সীমান্ত ফাঁড়ির কোম্পানী কমান্ডার নায়েক সুবেদার মো. ইয়াকুব আলী আজ মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, এ বিষয়ে তিনি কোন কিছু জানেন না। নিখোঁজদের পরিবারের পৰ থেকেও এ বিষয়ে কোন অভিযোগ দেওয়া হয়নি।
অপরদিকে র্যাব-১৪’র (শেরপুর-জামালপুর) অধিনায়ক মেজর নাইম আব্দুলৱাহ বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। এ সংক্রান্তে আমরা কাউকে আটক বা কারও বির্বদ্ধে মামলা করিনি।’ তবে বিষয়টি র্যাবের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস’ার মাধ্যমে অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।