কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈশাখ আমেজে মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যাপক আয়োজন
এইচ.এম জোবায়ের হোসাইন, ত্রিশাল প্রতিনিধিঃ কথায় বলে, বাঙালি আমুদের জাতি, উৎসব প্রিয় জাতি। উৎসব পেলে অন্য সবকিছু ভুলে থাকতে পারে। আর সেই উৎসবে জাতির অপেক্ষা মাত্র ১দিন।
তার পরেই পুরো বাংলা সাজবে বর্ণিল সাজে। কেননা চলে এলো বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখে সারা পৃথিবীর বাঙালিরা মেতে উঠে প্রাণের উৎসবে।
বেশ কয়েকজন তরুন শিক্ষার্থী গভীর মনোযোগে তুলির আঁচড়ে সরায় নকশা করছেন। কাজ শেষ হলে এখান থেকে সরাগুলো চলে যাচ্ছে সামনে রাখা আরেকটি টেবিলে, যেখানে এক সারিতে সাজানো চিত্রিত সরা। আছে কাগজের পাখি, টেপা পুতুল, দেয়ালে সাজানোর জন্য মুখোশ।
ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের এসব কর্মযজ্ঞ ও নিত্যদিনের এ চিত্র জানান দিচ্ছে যে পয়লা বৈশাখ আসতে আর দেরি নেই। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালনের খোরাক যোগানোর জন্য চলছে এই কর্মযজ্ঞ।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং ছিলেন বৈশাখের প্রতীক। তিনি নিজেই কাল বৈশাখীর মত আবির্ভুত হন বাংলা কবিতায়। স্বয়ং কবি নিজেই তার বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী”তে বলেছেন- “আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল বৈশাখীর” বিশ্ববিদ্যালয়ের “গাহি সাম্যের গান মঞ্চে” চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার কর্মযজ্ঞ। এ প্রাঙ্গণে নবীন-প্রবীণ শিক্ষার্থীরা কাজে মেতে আছেন।
কেউ বাঁশ-কাঠ কাটাকুটি করছেন, কেউ কাগজ কাটছেন বিভিন্ন আকৃতির। বাংলা পঞ্জিকার পাতায় চৈত্রের মাত্র আর ১দিন বাকি। কর্মব্যস্ত চারু কলায় দেখা গেল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তপন কুমার সরকার, সহকারী অধ্যাপক মাসুম হাওলাদার, সিদ্ধার্থ দে এবং দ্রাবির সৈকত সহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা মহা ব্যস্ত। তাঁরা চারুকলার বর্ষবরণ শিল্পকর্ম গড়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন।
নতুন, বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন সিনিয়র শিক্ষার্থীরাও। চারুকলা বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী দিপংকর বৈরাগী জানালেন, রীতি অনুযায়ী শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরাই এই মহাযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চৈত্র সংক্রান্তি এবং নতুন বছরকে বরণের আয়োজনে এবার যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা, পালা গান, ছড়া গান, লাঠি খেলা, ফানুস ওড়ানো, বাউল গান, নৃত্যপালা, লোকজ সামগ্রীর প্রদর্শনীসহ এবারের আয়োজনে থাকবে চৈত্র সংক্রান্তির বিকেল থেকে পহেলা বৈশাখের রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠানমালা। তারই প্রস্তুতি হিসেবে রাতদিন চলছে মুখোশ, লোকজ মোটিফ বানানো, পালা, গান, নাটকের প্রস্তুতিপর্ব।
বর্ষ বরণ করে নিতে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দ্রাবির সৈকত বলেন, বর্ষবরণ বাঙালির প্রাচীনতম ঐতিহ্যের প্রবাহ, যা আজো প্রবল স্রোতের মতোই উদ্যম আনন্দ বহমান, জীবিত সংস্কৃতির এই হলো প্রধান বৈশিষ্ট, যুগের সকল পরিবর্তনকে গ্রহন বর্জনের ভিতর দিয়ে তার নিজস্ব একটি রূপ নির্মিত হয়।
চারুকলা বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, করিডরের উন্মুক্ত জায়গায় অস্থায়ীভাবে স্থাপিত বিশাল টেবিলের ওপর ছড়িয়ে আছে সারি সারি সরা। সেগুলোর ওপর রঙের প্রলেপ দিয়ে নানা অবয়ব ফুটিয়ে তুলছেন শিক্ষার্থীরা। শুধু চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরাই নন, নিজের আগ্রহে অনেকেই আসছেন এই কর্মযজ্ঞে শামিল হতে।
পহেলা বৈশাখ ১৪২৩ উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক ট্রেজারার প্রফেসর এ.এম.এম. শামসুর রহমান, সদস্য সচিব চারুকলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ ফখর উদ্দিন (দ্রাবিড় সৈকত) জানান, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় পালা নৃত্য, নাটক, পানুশ উড়ানো অনুষ্ঠিত হবে। ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ সকাল ৯টায় মঙ্গল শোভাযাত্রা, শোভাযাত্রায় থাকবে বাঘ, হাতি, ঘোড়া, রাজা-রানী, খড়ঘোশ, মোরগ, পেঁচা, ব্যঙ, পুতুল, বক, পাখা, অসংখ্য মুখোশ ইত্যাদি। বিকালে বিশ^বিদ্যালয় মাঠে থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনে ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা, বিকালে ‘গাহি সাম্যের গান মঞ্চে’ থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, সঙ্গীত বিভাগ, ফোকলোর বিভাগ এবং মিডিয়া এন্ড ফিল্ম বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আদিবাসী নৃত্য, সাধারণ নৃত্য, গান, নাটক অনুষ্ঠিত হবে।
বর্ষবরণের মূল উদ্দেশ্যটি উল্লেখ করে লোক প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক সঞ্জয় মূখার্জী বলেন, এবারের বর্ষবরণের মূল উদ্দেশ্য হোক বাংলার ক্রিষ্টি ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে সকল বিভেদ ভুলে নব উদ্যমে সবাই মিলে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, বিজ্ঞানসম্মত এবং মজবুত অর্থণীতির দেশ গড়ার প্রত্যয়। দেশের বর্তমান দুরবস্থা থেকে উত্তরণের আশা নিয়ে আমাদের জীবনে আসুক ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। বৈশাখ আমাদের কাছে আসুক দুরবস্থা উত্তরণের সৃষ্টিশীল বিকল্পের উৎস হয়ে। যা এ দেশের অগ্রযাত্রায়, উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, বৈশাখী চেতনা বিস্তারে শেষ প্রতিরোধ, পরম ভরসা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য প্রফেসর ড. মোহীত উল আলম বলেন, এবারে বাংলা নববর্ষ বরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুবলা বিভাগ ব্যাপক আয়োজন করেছে। বর্ষ বরণের জন্য সরকার বরাদ্ধ দেওয়ায় এবারের আয়োজনে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। বাংলার ঐতিহ্য লালন করে চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রকারের কারু কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।