‘ভিশন-২০৩০’-এর রূপরেখা তুলে ধরলেন খালেদা জিয়া

স্টাফ রিপোর্টার | ১৯ মার্চ ২০১৬, শনিবার,
দলের জাতীয় কাউন্সিলে ভবিষ্যতে সরকার ও দল পরিচালনার রূপরেখা-‘ভিশন-২০৩০’ এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, দেশের বিশিষ্ট জন, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও সবার মতামতের ভিত্তিতে এই ভিশন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে। এবং পরবর্তীতে তা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু আয় পাঁচ হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত করা হবে। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে সংসদে উচ্চ কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। দুপুরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গনে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, জনগণের দুর্দশা আমাদের হতাশ করেছে। এমন এক অবস্থা চলতে পারে না। নষ্ট রাজনীতির আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশ আরও ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। বিএনপি এমন অবস্থা থেকে উত্তরণে ভিশন ২০৩০ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। দেশের অগ্রসর চিন্তাবিদ ও বুদ্ধজীবী ও শীর্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সকল অঞ্চলের সব ধর্মের মানুষের আশা আকাঙ্খাকে ধারণ করেন বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তোলা বিএনপির লক্ষ্য। বিএনপি বিশ্বাস করে জনগণই সকাল উন্নয়নের চালিকা শক্তি। আমরা এমন এক উদার গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাই যেখানে সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষিত হবে। আমরা সকল মত ও পথকে নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাই যেখানে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে। বাংলাদেশ হবে একটি রেইনবো। জন আকাঙ্খাকে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবো আমরা। সব ধরণের অভিজ্ঞতার নির্যাস গ্রহণ করে দেশ পরিচালনাই হবে আমাদের লক্ষ্য।
তিনি বলেন, জনগণের জবাবদিহিতামূলক শানস ব্যবস্থা ছাড়া কোন উন্নয়ন হতে পারে না। এর প্রমাণ আমরা দেখছি। আমরা জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি। এজন্য তাদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চাই। সুনীতি সুশাসন ও সুসরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে আমাদের লক্ষ্য। সততা, দক্ষতা, মেধা, দেশপ্রেম ও যোগ্যতা হবে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের যোগ্যতার মাপকাঠি। সব বাহিনীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে দলীয় সব অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে। সব ধরণের নিষ্টুর আচরণ থেকে মানুষকে মুক্ত করা হবে। উচ্চ আদালতের নিয়োগের জন্য আইন করবে বিএনপি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, অখন্ডতা রক্ষায় সমর সম্ভারে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা হবে আধুনিক সামরিক বাহিনী। দেশবাসী গভীরভাবে উপলদ্ধি করেছে প্রধানমন্ত্রীর সীমাহীন ক্ষমতা স্বৈরতন্ত্রে রূপ নিয়েছে। বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা পরিবর্তন করে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। জাতীয় সংসদকে দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট করার উদ্যোগ নেয়া হবে। বর্তমান সরকার মুখে জনগণের কথা বললেও জনগণের সেই ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে। গণভোটের অধিকার এনে জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবো।
খালেদা জিয়া বলেন, সকল স্তুরে ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ সেবা ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক এবং দক্ষ ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। বিএনপি দুর্নীতির সঙ্গে কোন আপস করবে না। কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি আইন ও পদ্ধতিগত সংস্কার এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। বিএনপি দুর্নীতি করবে না, কাউকে করতেও দেবে না। গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য অনেক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার জন্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করা হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে গণশুনানির ব্যবস্থা থাকবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় রাজনৈতিক বিবেচনা বন্ধ করা হবে। ভেজাল প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপতার বিরুদ্ধে বিএনপি সব সময় সক্রিয়। জঙ্গিবাদী নাশকতাকে আমরা কঠোরভাবে নিশ্চিহ্ন করেছিলাম। গেপ্তার, বিচার করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে সেই কঠোরতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করে যাব। বাংলাদেশের ভুখ-ের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বরদাশত করবে না বিএনপি। বাংলাদেশের মাটি থেকে অপর দেশে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা মেনে নেয়া হবে না। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বিরোধী কর্মকৌশল হিসেবে দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান ও আন্ত:ধর্মীয় সংলাপকে উৎসাহিত করা হবে। শিক্ষাকে কর্মমুখি ও ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে। এক দশকের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষতা দূর করা হবে। উচ্চ শিক্ষা হবে গুনগতমানের শিক্ষা। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হবে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করা হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সুযোগ থাকবে। যাতে তারা কোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে না পড়ে। বিশেষ অগ্রাধিকার লাভ করবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত। মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান করতে বিশেষ তহবিল করা হবে। মেয়েদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হবে। শিক্ষার সব ক্ষেত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধা এবং ছেলে-মেয়ের বৈষম্য দূর করা হবে।
তিনি বলেন, সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করা হবে। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বিএনপি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিএনপি অন্য কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করবে এটিও চায় না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার পরিবেশ গড়ে তুলতে চায়।
তিনি বলেন, আগামীতে তৈরি পেশাক শিল্প ও প্রবাসীদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। উৎপাদন ও সেবা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে। যাকাত ফান্ডের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো হবে। হজ ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান নৈরাজ্য ও দুর্নীতির অবসান ঘটানো হবে। বিএনপি চায় বিভক্ত হওয়া জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। এজন্য সবার মধ্যে সেতুবন্ধন রচনার প্রয়াস চালানো হবে। প্রতিহিংসার পরিবর্তে ভবিষ্যতে নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার করতে চায় বিএনপি।
সরকারের জুলুম নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, অনেকে চরম নির্যাতিত হয়েছেন। অনেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। চরম দুঃখের দিন কেটে যাবে। এই জুলুম ও অস্থিরতা বাংলাদেশ বহন করতে অক্ষম। আমি নিজেও চরম দুঃখ কষ্ট সয়ে আপনাদের মাঝেই রয়েছি এবং থাকবো। আমি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন। আমার ছোট ছেলে বিদেশে মৃত্যুবরণ করেছে। তারেক রহমানকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। পঙ্গু হয়ে বিদেশে বসবাস করছে। এসব দুঃখ বেদনা বুকে চেপে এদেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিএনপির জন্য এটি কঠিন সময় হলেও বিএনপি আবার জেগে উঠেছে। দুঃসময় আসলেও ফিনিক্স পাখির মতো নতুন উদ্যমে জেগে উঠে বিএনপি।