খালেদা ও তারেককে পুনঃনির্বাচন দুই আসামীকে স্বীয় পদে রাখার একটা নাটক : প্রধানমন্ত্রী
ঢাকা, ৭ মার্চ ২০১৬ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির চেয়ারপার্সন পদে বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে তারেক রহমানের পুনঃনির্বাচন দুই আসামীকে স্বীয় পদে রাখার নাটক বলে অভিহিত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘নাটকটা ভালো হলো, নির্বাচিত দু’জনই মামলার আসামি। একজন এতিমের টাকা মেরে দেয়া মামলার আসামি। আরেকজন মানুষ হত্যার, গ্রেনেড হামলার আসামি। যার নাম আবার ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড লিস্টে রয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আড়াই হাজার বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাষণ।.. আজ ৪৫ বছর পরেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আবেদন বাঙালির কাছে অটুট আছে।’
লেখক ও ইতিহাসবিদ জেকব এফ ফিল্ড’-এর বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা গ্রন্থে এই ভাষণ স্থান পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসংখ্য ভাষায় অনুদিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ববাসীর কাছে বিশেষ করে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে আলোর দিশারীতে পরিণত হয়েছে।
জাতীয় সংসদের উপনেতা ও সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে জনসভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জন প্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বক্তৃতা করেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্র্রীয় ও মহানগর নেতৃবৃন্দের মধ্যে আরো বক্ততা করেন কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এমপি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি এমপি ও জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এ কে এম রহমতুল্লাহ এমপি, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক প্রমুখ।
কেন্দ্রীয় নেতা অসীম কুমার উকিল এবং সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জনসভা পরিচালনা করেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এ ভাষণ দিয়েছিলেন ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী দুঃশাসন থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেয়ার জন্য। ১৯৪৮ সালে ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করার সময়ই বঙ্গবন্ধু বুঝে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা ব্যতীত এই জাতির চূড়ান্ত মুক্তি মিলবে না।
তিনি বলেন, রেসকোর্সের জনসমুদ্রে দেয়া জাতির পিতার এই কালজয়ী ভাষণে ধ্বনিত হয়েছিল বাংলার গণমানুষের প্রাণের দাবি। এই ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেন। আবার সশস্র সংগ্রামের দিক-নিদের্শনাও দিয়ে যান।
তাঁর নিজেরও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় রেসকোর্সে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২ মার্চের ডাকে ৭ মার্চ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছুটে আসে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পাওয়ার জন্য। তিনি তাদের সেই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই ভাষণেই তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শত্রুর মোকাবিলার জন্য বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ইপিআর’র (বর্তমান বিজিব) ওয়্যারলেসে সে ভাষণ সরবরাহ করার পর দেশের গ্রামে-গঞ্জে মাইকের মাধ্যমে, চোঙ্গায় ফুঁকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণ প্রচার করে।
তিনি বলেন, এই ঘোষণাই আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান চট্টগ্রাম কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকেও প্রচার করেন।
রক্তক্ষয়ী বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার আহবানে সাড়া দিয়েই সমগ্র বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ হন। ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রমহারা হন। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধু মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশকে পুনর্গঠনকালীন সময়েই ঘাতকরা তাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেই এদেশে স্বৈরশাসন এবং যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনের সূচনা করেন।
তিনি বলেন, ‘জিয়া অবৈধভাবে সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বাতিল করেন এবং ৩৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দেশে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে তাদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে রাজনীতি করার অধিকার দিয়ে দেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জিয়াই গোলাম আজম গংদের পাকিস্তানী পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে তাদের এদেশের নাগরিকত্ব এবং রাজনীতি করার অধিকার দেন। তারই ধারাবাহিকতায় বজায় রেখে বেগম জিয়া শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী নিজামীদের মন্ত্রী বানান বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
তিনি বিএনপি চেয়ারার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের সরকার উৎখাতের আন্দোলনের নামে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে পরবর্তী ৯২ দিনে একটি অফিসে ৬৮ জন সদস্যসহ অবস্থান করে মানুষ হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, বেগম জিয়া একটি অফিসে আরাম আয়েশে অবস্থান করে প্রায় আড়াইশো মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্যদের হত্যার নির্দেশনা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বাবার সামনে ছেলেকে, বউয়ের সামনে স্বামীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে পেট্রল বোমা মেরে পুড়িয়ে এসব হত্যাকান্ডের বিচারও একদিন বাংলার মাটিতে অনুষ্ঠিত হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি ’৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারগুলোকে উচ্চ আদালতের রায়ে অবৈধ ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, অবৈধভাবে যাদের সৃষ্টি তাদের কাছে দেশের মানুষ আর কি বা আশা করতে পারে।
সদ্যসমাপ্ত এশিয়া কাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের রানারআপ হওয়ার যোগ্যতা অর্জনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছি, রানার্সআপ হয়েছি। এই পর্যন্ত যেতে পারাটাই অনেক সম্মানের। ভবিষ্যতে আরও বহুদূর যাবো।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ৭মার্চের ভাষণে বলেছিলেন ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’-ঠিকই পারেনি। খেলায় এখন বাঙালিকে হিসাব করে বিশ্বের মানুষ। আমি চাই, আমার দেশের প্রতিটি মানুষ এই চেতনা নিয়েই এগিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। আমরা মাথা উঁচু করেই চলতে চাই। আমরা কারো কাছে ভিক্ষার হাত পাততে চাই না। আমরা চাই সবার যেন একটা বাসস্থান হয়, আর একজন মানুষও যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।
তিনি এ প্রসঙ্গে সারাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে ৩০ পদের ঔষধ প্রদান, ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ২শ’ প্রকার সেবা, ইন্টারনেটকে সহজলভ্য করে দেয়াসহ সাধারণের উন্নয়নের বিভন্ন খন্ড চিত্র তুলে ধরেন।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলেই দেশের উন্নতি হয় উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমরা জাতির জনকের কাঙ্খিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথেই দেশকে নিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বমন্দার মাঝেও গড়ে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, পাঁচ গুণ বাজেট বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার অংশ হিসেবে বছরের প্রথম দিনে সারাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, ডিগ্রী পর্যন্ত প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান প্রভৃতি বিষয়ও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সাড়ে ১৭ মিনিটের ভাষণ আজ বিশ্ব মানবতার সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ছিল কৌশলী ভাষণ। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বৃহত্তর যুদ্ধের জন্য বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে। যে কারণে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ছাত্র, শ্রমিক-জনতা ও পুলিশ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার সময় পেয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মিলিটারি ট্রেনিং ছিল কি না আমার জানা নেই। তবে, তাঁর বক্তৃতা ছিল সম্পূর্ণ একটি গেড়িলা লড়াই চালানোর পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা।’
দুপুরের পর থেকেই জনসভা স্থলে ঢাক-ঢোলকসহ বাদ্য বাজিয়ে, শ্লোগানে শ্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে দলে দলে মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে জনসভাস্থলে আশা শুরু করে। বিকেল ৩টায় জনসভা শুরুর সময়ই সমগ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জনসমাগমে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। পৌনে চারটায় প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে আরোহণের সময় সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়।