স্কুলছাত্রী নাদিরা হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন : হত্যাকারী হাবিব এমপির বাসা থেকে গ্রেফতার
মতিউল আলম, ১৩ নভেম্বর ২০১৫, শুক্রবার,
ময়মনসিংহে নিহত স্কুলছাত্রী নাদিরার শোকে বাবা-মা পাগল প্রায়। আজ শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানায় মামলা করতে এসে মা-মা চিৎকার করে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিল পিতামাতা।। গরীব ভ্যান চালক বাবা ইউনুস আলী ভাঙ্গা গলায় বলছিল মা তুমি কোথায়? আর জোরে জোরে বুক চাপড়াচ্ছিল। উপসি’ত সবাই সান্তনা দিচ্ছিল বাবা-মাকে। তখন নিহতের বাবার বলছিল আমি মেয়ে হত্যাকারী হা্বিবের ফাঁসি চাই। পাশে বসে মেয়ের চাচা উজ্জল হত্যার ঘটনা বর্ননা দিচ্ছিল। তিনি জানান, গত ১২ নভেম্বর সকাল ৯টা দিকে প্রতিদিনের মতো শহরের মাসকান্দা গণসার মোড় হাজী রাড়ি এলাকার বাসা থেকে ভ্যান চালক ইউনুস আলী মেয়ে নাদিরা সুলতানা আইরিন (১১) বই খাতা নিয়ে স্কুলে যায়। সে জেলা পরিষদ স্কুলের ৩য় শ্রেণীর ছাত্রী। বৃহস্পতিবার বেলা ১ টার দিকে স্কুল ছুটি হয়। বাসায় যাওয়ার পথে একটি প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ ০১৪-৮০৯৯ ) নিয়ে উৎপেতে থাকা তারই ফুফাত ভাই ড্রাইভার হাবিবুর রহমান হাবিব নাদিরাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। বেলা ৩টা পর্যন- নাদিরা বাসায় না ফেরায় পরিবারের লোকজন খোজাখুজি শুরু করে। নাদিরা বাবা মেয়েকে খুজতে স্কুলের সামনে আসলে প্রত্যক্ষদশীরা জানায়, স্কুলের ড্রেস পরা একটি মেয়েকে একজন যুবক প্রাইভেট কারে তুলে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ টা বা ৪টার দিকে চাচা উজ্জলের মোবাইলে ফোন আসে বাদে কল্পা বাইপাস সড়কে পাশে ধান ক্ষেতে স্কুল ড্রেস পরিহিত এক মেয়ের লাশ পাওয়া আছে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনা স’লে পৌছে যায়, পরিবারের লোকজন গিয়ে লাশ সনাক্ত করে। নাদিরা মা জানান, পাশের বাসায় থাকে নাদিরার ফুফু হাফিজার ছেলে ড্রাইভার হাবিব। হাবিবের বাবার নাম সাইফুল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি ত্রিশাল উপজেলায়। হাবিব মোবাইল চার্জ দিতে প্রায়ই তাদের বাসায় যেত। অহরহ যাতাযাতের জন্য নাদিরার বাবা ইউনুস তার ভাগ্নে হাবিবকে অহরহ যেতে মানাও করেছিল। হাবিব এমপি অনোয়ারুল আবেদিন তুহিনের গাড়ির ড্রাইভার।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবি সহকারী শফিকুল ইসলাম তপন জানান, অনুমান আড়াইটার দিকে আকুয়া খালেরপাড় নামক স’ানে হাবিব যখন নাদিরাকে নিয়ে প্রাইভেটকারে করে যাচ্ছিল তখন রাস-ার পাশে থাকা লোকজন মেয়ের কান্না শুনতে পায়। তাদের সন্দেহ হলে গাড়িটি আটক করে চালকের আসনে বসা হলুদ গেঞ্জি পড়া ড্রাইভার হাবিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মেয়েটি কাঁদছে কেন। হাবিব জানায়, তার ছোট বোন বাসায় যেতে দেরী হচ্ছে বলে কাঁদছে। গাড়ির পিছনের সিটে বসা মেয়েকে জিজ্ঞাসাকে করলে সে জানায় তার ভাই হয়। বাসায় যেতে দেরী হচ্ছে বলে সে কাঁদছে। গাড়িটি ছেড়ে দিলে বাইপাস সড়কে মুক্তাগাছা দিকে চলে যায়। এসময় তপন প্রাইভেটকারের নম্বরটি লিখে রাখেন। ঘন্টা- দেড় ঘন্টা পরে টেলিভিশনে খবর দেখতে পান ধান ক্ষেতে স্কুলছাত্রী লাশ পাওয়া গেছে। লাশ দেখে নিশ্চিত হন ঘন্টা দেড়েক আগে আটক সেই মেয়েটি। তিনি সাথে সাথে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে বিস্তারিত জানান। ডিবি পুলিশ তপনকে সাথে নিয়ে হাবিবকে সনাক্ত করে।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে শহরের সানকিপাড়া এলাকায় ময়মনসিংহ-৯ (নান্দাইল) আসনের আওয়ামীলীগের সাংসদ অনোয়ারুল আবেদিন তুহিনের নিজ বাসায় অভিযান চালিয়ে গাড়ির ড্রাইভার হাবিবুর রহমান হাবিবকে (২২) আটক করে। এ নারকীয় হত্যাকান্ডের হোতা ড্রাইভার হাবিব জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত এমপির প্রাইভেটকারটি ব্যবহার করে।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমারত হোসেন গাজী এর সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, স্কুলছাত্রী নাদিরাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ফুঁসলিয়ে একটি গাড়িতে তুলে। পরে গাড়িতেই নাদিরার শ্বাসনালীতে ছুরি দিয়ে উপর্যপুরি আঘাত করে ও গলা কাটার চেষ্টা করে ঘাতক হাাবিব। এসময় তার মৃত্যু নিশ্চিত করে শহরতলীর বাদে কল্পা এলাকায় একটি ধানক্ষেতের পাশে মরদেহ ফেলে রেখে যায়। পুলিশ জানায় গলায় ৩ টি কোমড়ের ডান পাশে ১৩টি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিন্হ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে গাড়িতে তাকে হত্যা করে লাশ ফেলে দিয়েছে। নাদিরার পরে বৃহস্পতিবার বিকেলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদনে- পাঠায়।
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তা আরো জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, নাদিরাকে ড্রাইভার হাবিব বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের কু-প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। কিন্ত সে তার রাজী না হওয়ায় এবং জানাজানি হবার ভয়ে তাকে হত্যা করা হয়। নিহত নাদিরা ঘাতক ড্রাইভার হাবিবের ফুফাতো বোন। এ ঘটনায় নাদিরার বাবা ইউনুস আলী বাদী হয়ে হাবিবকে আসামী করে কোতোয়ালী মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে।
এমপি ধরিয়ে দিলেন হত্যাকারী তার ড্রাইভারকে
সা্!ংবাদিকদের এমপি তুহিন বলেন, মুন্না প্রায় তিন বছর ধরে আমার প্রাইভেটকারের চালক হিসেবে চাকরি করছিলেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে আমার বড় ছেলেকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে এসে গাড়ি মেরামত করতে গ্যারেজে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে পড়েন মুন্না।
আমার স্ত্রীকে ফোন করে তিনি বলেন, যে গাড়ি নিয়ে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। এদিকে, সন্ধ্যার দিকে পুলিশ সুপার (এসপি) আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার আপনার গাড়ির চালকের নাম কী হাবিব? আমি বললাম না, আমার প্রাইভেটকার চালকের নাম মুন্না। ১০ মিনিট পর পুলিশ সুপার আবার ফোন করে শিশু হত্যার কথা আমাকে খুলে বলেন। আমি তখন নান্দাইলে। সেই সঙ্গে কৌশল করে কথা বলে মুন্নাকে বাসায় নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি। সে অনুযায়ী আমার স্ত্রী তাকে প্রাইভেটকারসহ বাসায় আসতে বলেন। পরে মুন্না এলে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এমপি আরো বলেন, আমি ভাবতেই পারিনি যে মুন্না এমন নৃশংস ঘটনা ঘটাতে পারেন। আমার ছোট ছোট দু’টি বাচ্চাকে মুন্নাই স্কুল থেকে আনা-নেওয়া করতেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, এ হত্যার সঙ্গে আরো কেউ জড়িত কী না তা খতিয়ে দেখা দরকার।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম জানান, আরো কেউ ঘটনার সাথে জড়িত কিনা এব্যাপারে আটককৃত হাবিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের আন্তরিক ভুমিকার জন্যই হাবিবকে দ্রুত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।