| রাত ৮:৪৭ - মঙ্গলবার - ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১৩ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

পবিত্র ঈদুল আজহা

শাহ্‌ সাইফুল আলম পান্নু, 
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা- ইল্লা-ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হাম্‌দ। আমাদের ধর্মীয় জীবনে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার গুরুত্ব অপরিসীম। ঈদুল আজহায় আমরা কোরবানি দিয়ে থাকি। জিলহজ্বের ১০ তারিখ ঈদের নামাজের পর হতে ১২ তারিখ সূর্যাসে-র আগ পর্যন- দিবস বা রাতে যে কোন কোরবানি করা জায়েজ। কুরবান কুরব শব্দ থেকে উদ্ধৃত। এর আভিধানিক ব্যাখ্যা হচ্ছে উপরোল্লিখিত সময়ে আল্লাহর রাহে সুনির্দিষ্ট কতিপয় পশু নির্ধারিত নিয়মে আল্লাহর সন’ষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করা। কোরবানি ইসলামের চিরন-রন বিধান। হযরত আদম (আঃ) এর যুগ থেক এই বিধান প্রচলিত। পৃথিবীতে প্রথম কোরবানি দিয়ে ছিলেন হাবীল ও কাবীল। গোটা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পশু কোরবানির যে প্রথা প্রচলিত রয়েছে, তার প্রবর্তক হচ্ছেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ:)। পবিত্র কোরআন মজিদের সুরা সাফ্‌ফাতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। আর যখন ইব্রাহীম (আ:) গন-ব্যস’লে (মিনায়) পৌছলেন, তখন স্বীয় পুত্রকে সম্বোধন করে বললেন, হে আমার বাছাধন, আমি স্বপ্নে দেখিছি আমি তোমাকে জবাই করেছি অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে তোমাকে জবাই করার জন্য অদিষ্ট হয়েছি। এখন তোমার অভিমত কি? পুত্র ইসমাইল বললো, আপনাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা আপনি সম্পন্ন করুন। এর পরবর্তী ঘটনা আমাদের সকলের জানা। মূলত স্বীয় পুত্রকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করে হযরত ইব্রাহীম (আ:) আত্মত্যাগের যে মহান আদর্শ স’াপন করে গেছেন, ঈদুল আজহায় আমরা তা অনুসরণ করি অর্থাৎ তাকওয়া শপথ নেই।
হজ্জে তামাত্তু ও কিরান আদায়কারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এ ছাড়া কোন ব্যক্তি যদি নিজের বৈধ্য উদ্দেশ্য পূরণের শর্তে কোরবানির মানত করে, তাহলে তার ওপর কোরবানি আদায় করা ওয়াজিব। কোরবানির গোস- অমুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করা জায়েজ। চমড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থ এতিমদের মধ্যে বিতরণ করা উত্তম। কোরবানির গোস- তিনভাগের এক অংশ নিজেদের, তিনভাগের এক অংশ আত্মীয়-পরিজন এবং তিন ভাগের এক অংশ গরীবদের হক। শুধুমাত্র গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ও গয়াল কোরবানি দেয়া যাবে। গরু, মহিষ, উট, গয়াল এক একটি পশুকে ৭ শরিক কোরবানি দিতে পারবে। গরু ও মহিষের বয়স ২ বছরের কম হলে কোরবানির জন্য জায়েজ হবে না। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। অর্থাৎ যে সকল পশুর দাঁত গজায়নি বা নেই এমন পশু কোরবানি দেয়া চলবে না। অন্ধ, কানা, শিংহীন এবং লেজকাটা পশু কোরবানির উপযুক্ত নয়। মোট কথা মোটা-তাজা এবং শক্তিশালী পশু কোরবানি করা উত্তম। কোরবানির জন্য নির্ধারিত তারিখ হচ্ছে ১০ই জিলহজ্ব সূর্য ওঠার পর থেকে ১২ই জিলহজ্ব সূর্যাসে-র পূর্ববর্তী সময় পর্যন-। শহর বন্দরের অধিবাসীদের ঈদের নামাজ আদায়ের পুর্বে কোরবানি জায়েজ নয়। গ্রামবাসীদের জন্য অবশ্য জায়েজ। তবে, ঘনবসতি সম্পন্ন গ্রাম হলে জায়েজ নয়। সেক্ষেত্রে ঈদের নামাজ আদায়ের পর কোরবানি দেয়া উত্তম। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মত্যগের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য ও সন’ষ্টি অর্জন করা। ত্যাগের মহিমায় মানুষের কল্যাণ সাধনা করা। সুরা হজ্জে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা করেছেন, কোরবানির গোস- ও রক্ত আল্লাহ চান না। তিনি গ্রহণ করেন শুধু বান্দার তাকওয়া বা হৃদয়ের গভীর আর্তি। কোরবানির ত্যাগের মহিমায় আমাদের জীবনে শানি- ও কল্যাণ নেমে আসুক এ কামনাই করছি পবিত্র ঈদুল আজহার শুভক্ষণে।
জিলহজ্ব কি? চন্দ্রমাসের শেষ মাস জিলহজ্ব। জিলহজ্ব মাস অতি পবিত্র মাস। এই মাসের ৯ তারিখে পৃথিবীর বহু মুসলমান আরাফাতের ময়দানের একত্রিত হয়ে হজ্বের ফরজ পালন করেন। যারা হজ্জ্বে শরীক হতে পারে না তারা ঐ দিন নফল রোজা রেখে বহু নেকীর অধিকারী হন। এমনকি ২ বৎসরের ছগীরা গুনাহ্‌ মাফ হয়। ১০ তারিখে ঈদের নামাজ পড়তে হয়। আল্লাহর নামে গৃহপালিত পশু গরু, ছাগল, দুম্বা, গয়াল, মেষ, মহিষ, উট ইত্যাদি কোরবানি করতে হয়। ৯ তারিখের ফরজ নামাজের পর থেকে প্রত্যেক নামাজীকে একবার তাকবীর তাশরীক বলতে হয়, তাকবীর আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা- ইল্লা-ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্ল্লাহিল হাম্‌দ।
কোরবানি কি? হযরত জায়েদ ইবনে আকরাম (রা:) হতে বর্ণিত “আমি জিজ্ঞাসা করলাম ইয়া রাসুল্লাল্লাহ- এই কোরবানি কি? নবী করিম (সা:) বললেন তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ:) এর সুন্নাত। (কোরবানীর জানোয়ারের শরীরে যত পশম আছে) প্রত্যেকটির বদলে একটি করে নেকী পাওয়া যাবে। (ইবনে মাজাহ আবু দাউদ)।
কোরবানীর দিনের ফজিলতঃ- ১। যে ব্যক্তি কোরবানির দিন নিজেকে ঈদের নামাজ পর্যন- খাওয়া, পান করা ও স্ত্রী সহবাস হতে সংযত রাখবে, সে যেন ষাট হাজার বৎসরের ইবাদত করল। ২। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজ পড়ার জন্য নতুন কাপড় পরিধান করবে এবং পুরাতন কাপড় আল্লাহ ওয়াসে- দান করবে। আল্লাহ্‌ তা’য়ালা কিয়ামতের দিন তাকে বেহেসে-র দশ রকম জেওর বা অলংকার পরাবেন। ৩। হুজুর পাক (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের দিন আতর ব্যবহার করবে এবং নিয়্যাত রাখবে যে, ফেরেস-াদের সাথে মোসাফাহ করবেন তা হলে আল্লাহ তাকে তার রাস-ায় ১০০ গোলাম মুক্তির সওয়াব প্রদান করবেন।
কোরবানীর বিবরনঃ- প্রত্যেক মুসলমান যাদের প্রতি যাকাত ফরজ ফেতরা ওয়াজিব চন্দ্র মাসের ১০ জিলহজ্ব তারিখে ঈদের আয্‌হার নামাজ আদায় এর পর হতে ১২ জিলহজ্ব এর সূর্যাসে-র পুর্ব পর্যন- যে কোন সময় কোরবানী করা ওয়াজিব।
ভাগে কোরবানীঃ একাধিক ব্যক্তির ভাগে সাত নামে গরু, মহিষ, গয়াল, উট, কোরবানী করতে পারেন। তবে সকলের নিয়্যাত কোরবানীর জন্য ছহী হতে হবে। টাকাও হালাল হতে হবে। যদি জানা যায় কারো ভাগের টাকা নাজায়েজ পথের তবে তাকে শরীক রাখা যাবে না। কেউ যদি গোশত খাওয়ার নিয়্যাতে শরীক হন তা ঠিক হবে না। গোশত মানুষেই খাবে তবে তার নিয়্যাত ও মাল খোদার উদ্দেশ্যে ছহী হতে হবে। এ জন্য ভাগে সাথী নেওয়ার সময় এ দিকগুলির প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে।
কোরবানীর পশুর বয়সঃ ছাগল ও ভেড়া এক বছরের, দুম্বা ছয় মাসের, গরু, মহিষ ও গয়াল দুই বছরের, উট পাঁচ বছরের হওয়া আবশ্যক। এর ব্যতিক্রম হলে কোরবানি জায়েজ হবে না। (মানতকরা কোরবানীর জানোয়ার ও উক্ত বয়সের হওয়া দরকার)।
কোরবানীর পশুঃ গরু, ছাগল, খাসী, উট, দুম্বা, ভেড়া, মহিষ, গয়াল ইত্যাদি হালাল পশু সুস’, সবল, মোটাতাজা এবং দেখতে সুন্দর হওয়া আবশ্যক। খোঁড়া, কানা, অন্ধ, পীড়িত অতি দুর্বল, অত্যন- বৃদ্ধ দাঁতহীন ও পাগল ইত্যাদি পশু দ্বারা কোরবানী করা যাবে না। কোরবানীর পশু সব দিক দিয়ে নিখূঁত হওয়া দরকার। পশুর কান ও লেজ অর্ধেকের (মতভেদ) এক তৃতীয়াংশের বেশী কাটা বা ভাঙ্গা থাকলে কোরবানী হবে না।
কোরবানী করার নিয়মঃ কোরবানীর জানোয়ারের মাথা দক্ষিণে রেখে বাম কাতে কেবলামুখী করে শোয়াতে হবে। সম্মুখে ডান পা ছিনার উপর রেখে বিস্‌মিল্লাহির আল্লাহু আকবার বলার সাথে সাথে ছুরি চালাতে হবে। কোরবানীর ছুরি অতি ধারালো হওয়া আবশ্যক। প্রথম কোরবানী দাতার নাম বলতে হবে এবং দ্বিতীয় দাতার পিতার নাম বলতে হবে। কোরবানী দাতা স্ত্রী লোক হলে ইবনে এর বদলে বিনতে বলতে হবে। যেমন আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ এবং জাকিয়া বিনতে আবদুল্লাহ। নিজের কোরবানীর পশু নিজের হাতেই জবেহ করা মুস-াহাব। যদি নিজে জবেহ করতে না পারে তবে অন্যের দ্বারা জবেহ করাবে কিন’ নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়ে লোক পর্দার ক্ষতি না হলে দাঁড়াতে পারে।
কোরবানীর অংশঃ দুম্বা, ছাগল, ভেড়া, খাসি একজনের নামে একটি কোরবানী হুকুম। মহিষ, গরু, গয়াল, উট সাত নামের জন্য একটিতে কোরবানী করা যাবে। সাত নামের বেশী জায়েজ নেই। গরু, মহিষ, উট, গয়াল দুই তিনজন ভাগে সাত নামে দিতে পারেন। তবে কোরবানীর অংশের টাকা অবশ্যই হালাল হতে হবে।
কোরবানীর চামড়াঃ- কোরবানীর চামড়া পাকা করে নামাজের বিছানা স্বরূপ নিজে ব্যবহার করতে পারবে। চামড়া বা চামড়া বিক্রিত টাকা এতিম, মিসকিন, গরীব, অসহায় মোসাফিরদের হক। এদেরকে দান করে দিতে হবে। কোরবানীর চামড়া বিক্রয়ের টাকা কোন মসজিদ, মাদরাসায় লাগানো জায়েজ নেই। তবে যেখানে এতিম, মিসকিন, অসহায় ছেলে মেয়েদের খাওয়া বা যে সকল মাদরাসায় লিল্লাহ বোর্ডিং ছহীভাবে চলছে সেখানে চমড়া বিক্রয়ের টাকা দান করা যাবে।
কোরবানী করার দোয়াঃ- “আল্লাহুমা মিনকা ওয়াইলাইকা ইন্নাছালাতি ওয়ানুছুকী ওয়া মাহইয়া ইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, লা- শারীকালাহু ওয়াবি জালিকা উমির্তু ওয়া আনা আউয়্যালুম মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন ফুলানে ইবনে ফুলানে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।” কোরবানী সম্পর্কিত সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় মাসআল্লা এখানে আলোচনা করা হলো। বিস-ারিতভাবে বা প্রয়োজন অনুযায়ী বিষয়াদী স’ানীয় আলেমদের মাধ্যমে জেনে নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।
অমুসলিমদের অত্যাচার থেকে মুসলিম রক্ষার জন্য ইসলামের কাজে প্রতিরোধে সম্মুখিন হলে চামড়ার টাকা ব্যয় করা যাবে। নও মুসলিম উপার্জনহীন, অভাবগ্রস-, অক্ষম, পঙ্গু, আশ্রয়হীন, অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস-, আত্মরক্ষার জন্য জম্মভুমি ছেড়ে আসা ইত্যাদি সকলকেই চামড়ার টাকা দান করা যাবে। কোরবানীর পশুকে প্রথমে গোসল করিয়ে নেবেন যাতে তার দেহের গোবর, কাদা, ময়লা প্রভূতি ধুয়ে যায়। দেহ শুকিয়ে গেলে পরে পশুকে জবেহ করবেন। জবাই করার দেড় থেকে দুই ঘন্টা পূর্বে পশুকে বেশী করে পানি খাওয়াবেন, এতে জবেহকৃত পশুর দেহ থেকে চামড়া ছাড়ানো সহজ হবে। জবেহ করার পর যাতে চামড়ার গায়ে রক্ত জমাট বেঁধে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। জবেহ করার জন্য ধারালো ছুরি এবং চামড়া ছাড়ানোর জন্য মাথা বাঁকানো ছুরি ব্যবহার করবেন। ছুরি ধারালো এবং পশু দেহের আকার অনুযায়ী বড়- ছোট হতে পারে। জবেহ করার পর পশুদেহ অসাড় হয়ে গেলে সেটাকে চিৎ করে শুইয়ে দু’পাশে দুটো ঠেস দিয়ে দেবেন যাতে সেটা হেলতে না পারে। ধারালো ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে গলা থেকে অর্থাৎ জবেহ করার স’ান থেকে লেজের কিয়দাংশ পর্যন- গলা, সিনা ও পেটের ওপর লোমের সংযোগ রেখা বরাবর দাগ দাগ কাটবেন। সামনের দু’পায়ের হাটু থেকে সিনা পযন- আরও একটি দাগ কেটে প্রথমোক্ত লম্বা দাগের সহিত যোগ করবেন। দাগ কাটা যেন আঁকা বাঁকা না হয় সে দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন। দাগ কাটা শেষ হলে প্রথমে গলার অর্ধেক ছাড়াবেন তারপর সামনের পা ছাড়িয়ে সিনা, কাঁধ ও পেটের চমড়া ছাড়াবেন। তারপর পেছনের পা ছাড়িয়ে পিঠ পর্যন- পৌছাবেন। সিনা ও লেজের আশেপাশের চামড়া গোশতের সাথে জড়িয়ে থাকে। কাজেই এ স’ানে চামড়া সাবধানে ছাড়াতে হবে। কেননা এখানে ছুরিতে কেটে যাওয়ার আশংকা থাকে।

সর্বশেষ আপডেটঃ ৮:৫০ অপরাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৫