| সকাল ৯:৫৪ - শনিবার - ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

শাবিতে শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা

অনলাইন ডেস্ক,   ৩১ আগস্ট ২০১৫, রোববার:

ভিসির পক্ষ নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের দফায় দফায় লাঞ্ছিত করা হয়েছে। ছাত্রলীগের হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষক আহত হয়েছেন। এ নিয়ে গতকাল দিনভর ছিল টান টান উত্তেজনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাম্পাসে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ওদিকে, এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। দুপুরে তারা বৈঠক করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সকাল ৯টা থেকেই ভিসি ভবনের সামনে পূর্ব নির্ধারিত অবস্থান কর্মসূচি ছিল আন্দোলনকারী মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের। গত কয়েক মাস ধরে চলে আসা সরকার সমর্থক শিক্ষকদের একাংশ ভিসির পদত্যাগ দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছেন। শিক্ষকদের এই আন্দোলন চলার মধ্যে সিন্ডিকেট সভা, একাডেমিক কাউন্সিলের সভাসহ কোন ধরনের নীতিনির্ধারণী সভা করতে পারেননি ভিসি। কয়েকদিন আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন নির্দেশনাসহ একটি চিঠি আসার পর গতকাল সকাল ১০টায় বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্ট্যাডিস ও বিকাল ৩টায় একাডেমিক কাউন্সিলের সভা ডাকেন ভিসি অধ্যাপক আমিনুল হক ভূঁইয়া। আর এই সভা প্রতিহত করার ঘোষণা দেন আন্দোলনরত শিক্ষকরা। এরই প্রেক্ষিতে গতকাল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভিসি ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন তারা। শিক্ষকদের ঘোষিত আন্দোলন প্রতিহত করতে সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ভিসি ভবনের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। পরে সকাল ৭টায় আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপস্থিত হলে ছাত্রলীগের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থী বলে দাবি করলেও ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি আবু সাঈদ আকন্দ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায় ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ উপস্থিত ছিলেন। সকাল আটটার দিকে ভিসি তার কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আন্দোলনরত শিক্ষকরা ব্যানার টানিয়ে ভিসিকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ভিসি ভবনের ফটকে বসা ছাত্রলীগ  নেতাকর্মীরা এ সময় এগিয়ে এসে শিক্ষকদের ব্যানার কেড়ে নিতে চায়। এ সময় শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক ধস্তাধস্তি শুরু হয়। শিক্ষকদের বাধার মাঝে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সহযোগিতায় এরই ফাঁকে কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন ভিসি অধ্যাপক আমিনুল হক ভূঁইয়া। ভবনে প্রবেশের পর ভিসি সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে যাওয়ার সময় শিক্ষকরা আবারও বাধা দিতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এ সময়  স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। ‘জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘শাবিপ্রবির মাটি ছাত্রলীগের ঘাঁটি’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এ সময় শিক্ষকদের ব্যানার কেড়ে নেয় এবং একই সঙ্গে হামলা চালায়। ছাত্রলীগের ধাক্কায় অধ্যাপক ইয়াসমিন হক মাটিতে পড়ে যান। কয়েকজন শিক্ষককে কিল, ঘুষি ও গলা ধাক্কা দিয়ে মারার পাশাপাশি এক ছাত্রলীগ কর্মীকে এক শিক্ষককে লাথি মারতেও দেখা যায়। একজন শিক্ষকের হাত থেকে এসময় রক্ত ঝরতেও দেখা যায়। শাবি ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সাঈদ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায় ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সবুজ হামলায় অংশ নেন। ছাত্রলীগ কর্মী পরিসংখ্যানের ধনী রাম রায়, সমাজবিজ্ঞানের আব্দুল বাতেন তন্ময়, বনবিদ্যার আরিফুর রহমান আরিফ, আব্দুস সালাম মঞ্জু, ইন্ডাস্ট্রিয়ালের কামরুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানের আরিফুর রহমান কেনেডি, জুয়েল, ইংরেজির ফয়সাল আহমদ, পরিসংখ্যানের তমাল, সমাজবিজ্ঞানের নজরুল ইসলাম, বনবিদ্যার জাহিদকেও প্রত্যক্ষভাবে হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়। ভিসিপন্থি হিসেবে পরিচিত ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তচিন্তা চর্চায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক আখতারুল ইসলাম, অধ্যাপক জহির বিন আলম, প্রক্টর অধ্যাপক কামরুজ্জামান চৌধুরী ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক রাশেদ তালুকদার ও সহকারী প্রক্টররা এ সময় দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে তারা কেউ ছাত্রলীগ কর্মীদের  ঠেকানোর চেষ্টা করেননি। জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার  হোসেন দুইপক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও ছাত্রলীগ কর্মীদের কাছে পাত্তা পাননি তিনি। কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে ভিসি ভবনের দ্বিতীয় তলায় তার নিজ কক্ষে অবস্থান করার পর ভবনের সামনে দফায় দফায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের নিচ তলায় অধ্যাপক ইয়াসমিন হক অবস্থান নিলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে ধরেন। এ সময় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে ভিসি ভবন থেকে বেরিয়ে অধ্যাপক ইয়াসমিন হক সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাদের ওপর হামলা করেছে। ভিসি তো এই ছাত্রলীগকে নিয়েই আছেন। এরাই তার পেটুয়া বাহিনী। এই যে পরিবেশ নষ্ট করা হলো, এর জন্য ভাইস চ্যান্সেলরই দায়ী থাকবেন। সকালে হামলা করার জন্য ভিসি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে রাতে বৈঠক করেন বলেও অভিযোগ করেন পদার্থবিদ্যার এই শিক্ষক। আন্দোলনরত শিক্ষকদের নেতা অধ্যাপক সৈয়দ সামসুল ইসলাম পরে বলেন, আমাদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে। আমাদের অন্তত সাতজন আহত হয়েছেন। ভিসি ছাত্রদেরকে আমাদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজে এবং অধ্যাপক ইয়াসমিন হক ছাড়াও মারধরের শিকার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক  মোহাম্মদ ইউনূস, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গণি, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাসানুজ্জামান শ্যামল, সহযোগী অধ্যাপক মো. ফারুক উদ্দিন, এনক সমাদ্দার, মোস্তফা কামাল মাসুদ সহ কয়েকজন। শিক্ষকদের ওপর হামলার খবর ও ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে কয়েকজন সাংবাদিককেও ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়। যমুনা টেলিভিশনের সিলেট ব্যুরো প্রধান মাহবুবুর রহমান রিপন বলেন, সারা দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার না হওয়ায় আজ তারা এ ঘটনা ঘটালো। সাংবাদিক লাঞ্ছিত করার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টায় বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্ট্যাডিস ও বিকাল ৩টায় একাডেমিক কাউন্সিলের সভা করেন ভিসি অধ্যাপক আমিনুল হক। দুপুর বারোটা পর্যন্ত ভিসি ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলেন, এই ভিসির পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। এরপর তারা সভা করতে একাডেমিক ভবনে চলে যান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন বলেন, আপনারা তো সবই দেখছেন। আমি এ বিষয়ে কিছু বলবো না। নো কমেন্টস। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার রোকন উদ্দিন বলেন, যারা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ও পক্ষে-বিপক্ষে তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের। পুলিশ ঘটনা প্রশমিত করেছে, যাতে রক্তক্ষয়ী কোন ঘটনা সংঘটিত হয়নি। এদিকে ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভূঁইয়া এই ঘটনাকে ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, আমাকে কার্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী আমি একাডেমিক কাউন্সিল করতে এসেছি। আর ছাত্ররা এসেছে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে। আজকে এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে এই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর হামলা হয়েছে এই রকম কোন অভিযোগ কোন শিক্ষকরা আমার কাছে করেননি। বরং শিক্ষকদের হামলায় আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি। শিক্ষকদের বাধায় আমি রাস্তা দিয়ে অফিসে প্রবেশ করতে পারিনি। আমাকে কাদা মাটি ও ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে আসতে হয়েছে। শিক্ষকরা হামলা বা লাঞ্ছিতের শিকার হয়েছেন এই রকম কোন অভিযোগ আমার কাছে আসলে আমি অবশ্যই তার বিচার করবো। আমি কার কাছে বিচার চাইবো? একই সঙ্গে প্রশ্ন রাখেন তিনি। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনার পর দুপুরে শাবি প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই হামলায় ছাত্রলীগ জড়িত নয় বলে দাবি করেন শাবি শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। শাবি ছাত্রলীগের সভাপতি বলেন, হামলার ঘটনাটি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নয়। ছাত্রলীগের কেউ এই ঘটনায় জড়িত আছে কিনা সে বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সকালে ভিসি ভবনের সামনে ছাত্ররা জমায়েত হলে আন্দোলনরত শিক্ষকরা আমাদের ডেকেছেন বলে আমরা সেখানে গিয়েছি। ছাত্রলীগের তিনজন নেতা হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখবো। সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং হুমকির বিষয়ে শাবি ছাত্রলীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ বলেন, যে দুইজন ছাত্রের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এসেছে তাদের দুইজনকে শাবি ছাত্রলীগের কর্মী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা কেউই আর শাবি ছাত্রলীগ করতে পারবে না। বহিষ্কৃত দুইজন হলো বনবিদ্যার আরিফুর রহমান আরিফ এবং সমাজবিজ্ঞানের আব্দুল বাতেন। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন শাবি ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু সাঈদ, সহ-সভাপতি অঞ্জন রায়, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজ, সাধারণ সম্পাদক ইমরান খান ও ছাত্রলীগ নেতা বিজিত লাল।
শিক্ষকদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা: হামলার ঘটনায় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ পরিষদের শিক্ষকরা। ঘোষিত কর্মসূচি অনুসারে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধদিবস কর্মবিরতি, কালোব্যাজ ধারণ এবং প্রতিবাদ র‌্যালি পালন করবে শিক্ষকরা। এছাড়া, ভিসি অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে এবং আরও কঠোরতর হবে বলে জানান আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র অধ্যাপক সৈয়দ সামসুল আলম।

সর্বশেষ আপডেটঃ ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ | আগস্ট ৩১, ২০১৫