| সন্ধ্যা ৬:১২ - মঙ্গলবার - ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ - ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ - ১৩ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

রাজাকার হাসান আলীর মৃত্যুদন্ডে তাড়াইলে শহীদ পরিবারগুলোর সন্তোষ প্রকাশ

আমিনুল ইসলাম বাবুল : ০৯ জুন ২০১৫, মঙ্গলবার,
কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার রাজাকার কমান্ডার সৈয়দ হাসান আলীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়ায় উপজেলার শহীদ পরিবারগুলোসহ মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন সনত্মুষ প্রকাশ করেছেন। এ রায়কে অভিনন্দন জানিয়ে কিশোরগঞ্জে আনন্দ মিছিল করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পর মঙ্গলবার হাসান আলীর মামলার রায়ের খবরে আনন্দিত নির্যাতনের শিকার তাড়াইল উপজেলার কোনাভাওয়াল, শিমুলহাটি, আড়াইউড়া, পশ্চিম সাচাইল গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার লোকজন। বছরের পর বছর পেড়িয়ে গেলেও এখানকার মানুষ এখনো ভুলেননি, তাদের উপর চালানো হাসান আলীর নৃশংসতার কথা। অনেক দেরিতে হলেও বিচার সম্পন্ন হওয়ায় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এসব মানুষ। রায় শুনে তাড়াইল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো.আবদুল হাই বলেন, রাজাকার কমান্ডার হাসান আলী ১৯৭১ সালে তাড়াইল থানায় ক্যাম্প করে বিভিন্ন স্থানে মানুষ নির্বিচারে মানুষ হত্যা, লুটপাট, অপহরণ ও অগ্নিসংযোগ করে বাড়িঘর পুড়িয়েছে। এ রায়ে তাড়াইলের মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ জনগণ খুশি হয়েছে।
মামলার বাদী একাত্তরে স্বামীসহ তিন দেবর হারানো শহীদ সতীশ চন্দ্র ঘোষের স্ত্রী সঞ্জুবালা ঘোষ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমার আর কোন চাওয়া নেই। আমি হাসান আলীর লাশ দেখতে চাই। আমার চোখের সামনে হাসান আলী অনেক নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। সে নিজের হাতে গুলি করে আমার স্বামী ও দেবরদের হত্যা করেছে, আমাকে সর্বহারা করে দিয়েছে। তিনি পলাতক হাসান আলীকে খুজে বের দ্রম্নত মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দাবি জানান।
তিনি আরও জানান, সেদিন রাজাকারদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তার স্বামী সতীশ চন্দ্র ঘোষ, দেবর সুরেষ চন্দ্র ঘোষ, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণ চন্দ্র ঘোষ ও প্রতিবেশী রম্নহিনী চন্দ্র ঘোষ, সুকুমার চন্দ্র ঘোষ ও ননী গোপাল ঘোষ। আর সেদিন উরম্নতে গুলিবিদ্ধ হয়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বিনা চিকিৎসায় থেকে দু্‌ই বছর পর মারা যান নরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ।
হাসান আলীর হাতে একাত্তরের ৯ সেপ্টেম্বর নিহত উপজেলার শিমুলহাটি গ্রামের অক্কুর পালের ছেলে সুনীল চন্দ্র পাল বলেন, দিনটি ছিল ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবার, হাসান রাজারের নেতৃত্বে দু’টি নৌকায় রাজাররা এসে আমার বাবাসহ ১২জনকে গুলি করে হত্যা করে গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। হাসান রাজারের মৃত্যুদন্ড হওয়ায় আমরা সবাই খুশি। একই কথা বলেন, শহীদ উপেন্দ্র পালের স্ত্রী রেনু রানী পাল, শরৎ চন্দ্র পালের ছেলে বেনু চন্দ্র পাল। তারা আরও বলেন, এতদিন আমরা বিচার পাইনি। এখন বিচার হওয়াতে ভালো লাগছে।
আড়াইউড়া গ্রামের শহীদ কামিনী ঘোষের ছেলে নৃপেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ ও চিকনী গ্রামের শহীদ জীবন চক্রবর্তীর ছেলে নারায়ন চক্রবর্তী বলেন, একাত্তরের ৮ অক্টোবর আড়াইউড়া গ্রামের কামিনী ঘোষের বাড়ি থেকে হাসান আলী ও তার লোকজন কামিনী ঘোষ ও জীবন চক্রবর্তীকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। হাসান আলীর মৃত্যুদ-ের রায় শুনার পর তারা আবেগ আপস্নুত হয়ে জানান, যুদ্ধাপরাধী হাসান আলীর বিচার না হলে এ জাতি কখনই কলঙ্কমুক্ত হতো না। এই রায়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাড়াইল উপজেলায় এক মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার হাসান আলী। বেপরোয়া ও উম্মত্ত আচরণের জন্য সৈয়দ হাসান আলী এলাকার মানুষের কাছে পরিচিতি ছিলেন ‘হাসান দারোগা’ নামে। দখলদার পাক বাহিনীর দোসর হিসেবে তার নেতৃত্বে এখানকার বিভিন্ন গ্রামে সংঘটিত হয়েছে গণহত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের মতো মানবতা বিরোধী অপরাধ।
সৈয়দ হাসান আলীর বাবা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমা শানিত্ম কমিটির চেয়ারম্যান। বাবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাসান আলী তাড়াইল থানায় রাজাকার কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত হন। তার ছোট ভাই হোসেন আলীও নিকলী থানায় রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে একাত্তরের ৯ সেপ্টেম্বর হাসান আলীর নেতৃত্বে তাড়াইল থানার শিমুলহাটি গ্রামের পালপাড়ায় একই সঙ্গে ১২ জনকে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অপরাধ সংঘটন। ওই গ্রামের পুরম্নষদের ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। এছাড়া ২৭ সেপ্টেম্বর তাড়াইল থানাধীন বোরগাঁও গ্রামে ৮ জনকে হত্যা ও ১০ জনকে অপহরণ ও লুটপাটেসহ আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডে নেতৃত্ব দেন হাসান আলী।
সরকার যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিচারের আওতায় আনায় সঞ্জুবালা ২০০৯ সালের ১৫মে রাজাকার হাসান আলীসহ সেদিন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের নামে কিশোরগঞ্জ আদালতে মামলা করেন। পরবর্তীতে এসব অপরাধসহ মুক্তিযুদ্ধের সময় মোট ২৪ জনকে হত্যা, ১২ জনকে অপহরণ ও আটক এবং ১২৫টি ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অপরাধ আমলে নিয়ে আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসান আলীর বিরম্নদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরম্ন করে। গতবছর ১১ নভেম্বর হাসান আলীর অনুপসি’তিতেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠিত হয়। এর আগে ২১ অগাস্ট ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর আবুল কালাম আজাদ হাসান আলীর বিরম্নদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন।
পরোয়ানা জারির পরও পুলিশ হাসান আলীকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ট্রাইব্যুনালের আদেশে তাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেয় প্রসিকিউশন। তাতেও তিনি হাজির না হওয়ায় আসামির অনুপসি’তিতেই বিচারিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১।
মামলার এজাহারে ত্রম্নটির অভিযোগ : রাজাকার কমান্ডার হাসান আলীর মৃত্যুদন্ডের রায়ের সন্তুষ্ট হলেও মামলার এজাহারে ক্রটির অভিযোগ করেছেন উপজেলার কোনাভাওয়াল গ্রামের শহীদ তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে লালু ভূঁইয়ার ছেলে মো. এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া। তিনি জানান, আমার চোখের সামনে ১৯৭১ সালের ২৩ আগস্ট রাজাকার হাসান আলীর নেতৃত্বে তার সহযোগিরা বাবাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে বাড়ির সামনে নিয়ে হাসান আলী ও তার সহযোগি উপজেলার ছনাটি গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে আলী মুর্ত্তুজা শহীদ তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া ওরফে লালু ভূঁইয়াকে গুলি করে হত্যা করে। কিন্ত, মামলার এজাহারে আলী মুর্ত্তুজার নাম ছিল না। এমদাদ হোসেন ভূঁইয়া আরও জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের জ্যেষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তা সানাউল হক সাহেবকে জানিয়েছি। পরে আদালতে আমি সাড়্গ্য দেয়ার সময় বিষয়টি বার বার উত্থাপন করলেও রহস্যজনক কারণে আলী মুর্ত্তজাকে এ মামলার আওতায় আনা হয়নি। এ সময় তিনি মাঠ পর্যায়ে মামলাটির অধিকতর তদনেত্মর মাধ্যমে আলী মুর্ত্তুজাকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। এমদাদ হোসেন ভূঁইয়ার এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলী মুর্ত্তুজা স্বাধীনতার পরই এলাকা ছেড়ে সিলেট শহরে পাড়ি জমায়। বর্তমানে তিনি সিলেট শহরের দীঘিরপাড় এলাকায় প্রসাদোপম বাড়ি করে বসবাস করছেন।

সর্বশেষ আপডেটঃ ৬:৫০ অপরাহ্ণ | জুন ০৯, ২০১৫